হোম > ছাপা সংস্করণ

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ীরা কি নির্বাচিত?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বাসভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের এবারকার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার-সমর্থিত গুন্ডাপান্ডাদের তৎপরতা তেমন একটা দেখা দেয়নি, এটা ঠিক। তার কারণ আছে, এই আন্দোলনের পেছনে ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। বাধা দিলে প্রবল হবে, সামলানো সহজ হবে না।

তবে সরকারপক্ষ যে নিষ্ক্রিয় থাকবে, সেটা কী করে সম্ভব? ইতিমধ্যেই খবর পাওয়া গেছে, ‘শিক্ষার্থীদের থামাতে মাঠে নেমেছে পুলিশ’ (আজকের পত্রিকা, ২৯. ১১.২১), এবং ‘আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এক ছাত্রীকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ।’ (সমকাল, ২৯. ১১.২১) ছাত্রীটিকে তার বাসা থেকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সঙ্গে তার পিতাও গেছেন, নিরাপত্তার কথা ভেবে। জিজ্ঞাসাবাদ উদ্দেশ্য নাকি পেছনে কোনো ‘ইন্ধনদাতা’ আছে কি না, তা জানা। আন্দোলন যে স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে, সরকারি লোকদের পক্ষে সেটা ধারণা করা কঠিন বৈকি। আর ধারণা করলে তো তাঁরা কাজই হারাবেন। ওই একই সময়ে পোশাকশ্রমিকেরাও রাস্তায় নেমে এসেছিলেন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে। বাসাভাড়া, নিত্যব্যবহার্য পণ্য, বাসভাড়া–সবকিছুই বেড়েছে, কিন্তু তাঁদের মজুরি বাড়েনি, বক্তব্য ছিল এটিই। তবে মালিকপক্ষ ঠিকই বলেছে যে এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র আছে, নইলে ‘হঠাৎ করে’ এই আন্দোলন কেন?

তরুণেরাও শৈশব থেকে ওই শিক্ষাই পেয়ে আসছে। স্বার্থপর হওয়ার শিক্ষা। স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণেরা সামাজিক হওয়ার শিক্ষাটা পায় না। গৃহে তারা একাকী। প্রশস্ত গৃহ অধিকাংশেরই নেই। তাদের সময় কাটে ঘরের অন্ধকার কোণে ইন্টারনেট ও মোবাইলে। খেলার মাঠ নেই, সামাজিক অনুষ্ঠানের সুযোগ অনুপস্থিত; নাটক দেখবে বা করবে, এমন কথা ভাবতেও পারে না; সিনেমা যে দেখবে এমন সিনেমা হলও নেই। কোনো কাজে তারা উৎসাহ পায় না। ফেসবুক তাদের বিপথগামী করতে চায়। কেউ কেউ ড্রাগে আসক্ত হয়েছে, অনেকেই হওয়ার পথে। বর্ণনা দীর্ঘ করা অনাবশ্যক।

শুধু এটুকু স্মরণ করলেই হয়তো তারুণ্যের প্রতি রাষ্ট্র শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে জানা যাবে যে ত্রিশ বছর ধরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যকর কোনো ছাত্র সংসদ নেই। অথচ ছাত্র সংসদ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপরিহার্য অংশ। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সামাজিক হয়, সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, সুযোগ পায় মেধা বিকাশের। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বসে থাকে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু মিলিতভাবে যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজে অংশ নেবে, তেমন সুযোগ পায় না। অথচ একসময়ে পেত। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ ছিল এবং থাকারও কথা। আইয়ুব খান ছাত্রদের সব ধরনের রাজনৈতিক কাজ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন; কিন্তু ওই তাঁর ভয়াবহ সময়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়েছে এবং নির্বাচিতরা গণতন্ত্রের পক্ষে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।

জেনারেল জিয়া এবং এরশাদের শাসনের কালেও ছাত্র সংসদ সজীব ছিল। কিন্তু এরশাদের পতনের পর যখন চতুর্দিকে আওয়াজ শোনা গেল যে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেছে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে, ঠিক তখন থেকেই কিন্তু ছাত্র সংসদের নির্বাচন বন্ধ হয়ে গেল। দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচনের দরুন সরকারের রদবদলও ঘটেছে। কিন্তু হায়, ছাত্র সংসদের প্রাণ ফিরে আসেনি। কোনো সরকারই আগ্রহ দেখায়নি। অন্যান্য ক্ষেত্রে ভীষণ পরস্পরবিরোধী মনোভাবাপন্ন হলেও এ ব্যাপারে তাদের ভেতর চমৎকার মিল দেখা গেছে। এই মিল নিশ্চয়ই তাৎপর্যহীন নয়। দেশের বুর্জোয়া শাসকেরা তরুণকে যে সন্দেহের চোখে দেখে, এটি তারই একটি নিদর্শন।

ওদিকে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের মানসম্মান যে বাড়ছে, এমন নয়। বায়ুদূষণে এবং সামগ্রিক বসবাস অযোগ্যতায় ঢাকা শহর সারা বিশ্বে শীর্ষ স্থানেই উঠে বসে আছে, নামার নাম নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডিসেম্বর মাসে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর একটি ভার্চুয়াল সম্মেলন ডেকেছেন। এতে চীন ও রাশিয়া যে নিমন্ত্রণ পাবে না, এটা তো জানাই ছিল। কারণ, তাদের বাদ দিয়ে, বস্তুত চীনকে কোণঠাসা করার জন্যই হয়তো এই ‘গণতান্ত্রিক’ সম্মেলন ডাকা। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে আগ্রহী বাংলাদেশও যে আমন্ত্রিতদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে, সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। দুশ্চিন্তারও বটে। ১১০টি দেশ নিমন্ত্রণ পেল, এমনকি প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও মালদ্বীপও বাদ পড়ল না, বাদ পড়ল শুধু বাংলাদেশ? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রথমে কোনো প্রতিক্রিয়াই জানায়নি, যেন এটি বিবেচনাযোগ্য কোনো ঘটনাই নয়।

পরে সাংবাদিকেরা যখন কৌতূহল প্রকাশ ও প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, তখন ২৩ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন তা ঠাট্টা কি না, বোঝা গেল না। তিনি বললেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত দুর্বল গণতন্ত্রের রাষ্ট্রগুলোকেই আমন্ত্রণ করেছে এবং ব্যাখ্যা করে জানালেন, ‘কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্র বিরাজ করছে। অত্যন্ত স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ সুষ্ঠু ও মুক্তভাবে ভোট দিতে পারছে।’ ভাবটা এই রকমের যে আমরা গণতন্ত্রের আগে উন্নতিকে স্থাপন করেছি বলে যে অভিযোগ আছে, সেটা মোটেই সত্য নয়, উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকে আমরা উন্নত করে ছেড়েছি। তবে বাংলাদেশে গত দুটি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়েছে–এমন কথা কিন্তু সরকারি দলের লোকেরাও বলেন না। বাইরে বলা আলাদা ব্যাপার, নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন যে ঠিকমতো হয়নি, বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। বাইরে থেকে যাঁরা নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা তো বলেনই না। স্টকহোমভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স নামে প্রতিষ্ঠানটি গত ২২ নভেম্বর ‘গণতন্ত্রের বৈশ্বিক পরিস্থিতি ২০২১’ নামে যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক নয়, কর্তৃত্ববাদী শাসনের তালিকাতেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘কিছু কিছু কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে, যা মোটেই স্বাধীন ও অংশগ্রহণমূলক নয়। এ ধরনের নির্বাচন আবার অনিয়মমুক্তও নয়। এসব দেশে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।’ (প্রথম আলো, ২৯. ১১.২১) অন্য এক বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সুশাসনের কথা বলে বিভিন্ন দেশকে চাপে রাখতে চায়।’ (সমকাল, ২৭. ১১.২১) এই বক্তব্যের অর্থ কিন্তু মোটেই পরিষ্কার হলো না। আশা করি, তিনি বোঝাতে চাইছেন যে সুশাসনের জন্য চাপ দেওয়াটা একটা অন্যায় কাজ।

দেশে ‘গণতন্ত্রের উন্নয়ন’ ঘটানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি বিশ্বমাপে আমাদের পাসপোর্টের মর্যাদা যে নিম্নমুখী, তার নিদান কী? বিশ্ব পাসপোর্ট ইনডেক্স নাকি জানাচ্ছে যে ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান এখন ১০৮ নম্বরে। (ডেইলি ট্রিবিউন, ০৬. ১০.২১)। বাইরে থেকে কী কেউ চাপ দিচ্ছে, নাকি নামার কারণ অভ্যন্তরীণ?

জাতীয় নির্বাচনের কথা না হয় বাদই রাখি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কী ঘটছে? এই নির্বাচনে সরকারের গঠন বা পতন হবে না। এখানে উৎসবমুখর থাকার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে উল্টো ছবি। দলীয় প্রতীক নিয়েই নির্বাচন হচ্ছে এবং নির্বাচনে ধানের শীষ নেই, তাই জেতার কথা নৌকাপ্রাপ্ত প্রার্থীদেরই। তাঁরা জিতেছেনও। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৩৪৮ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়; অর্থাৎ বিনা ভোটেই জিতে গেছেন। বোঝা যাচ্ছে এসব ক্ষেত্রে অন্য কারও পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগই ছিল না। প্রশ্ন উঠেছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের কি নির্বাচিত বলা যাবে? নির্বাচন মানেই তো পছন্দ করা; ভোটাররা যদি পছন্দই না করতে পারলেন, পক্ষে-বিপক্ষে ভোটই দিতে না পারলেন, তাহলে সেটা নির্বাচন হলো কোন অর্থে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তো জনপ্রতিনিধিরা বেরিয়ে আসবেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাঁরা ‘জয়ী’ হলেন, তাঁরা কোন অর্থে জনপ্রতিনিধি? কেউ তো তাঁদের ভোট দেয়নি। জনপ্রতিনিধিদের দায় থাকে নির্বাচকদের কাছে জবাবদিহির। এই ‘জয়ী’রা তো যুক্তিসংগতভাবেই বলতে পারেন যে কারও কাছে তাঁদের কোনো দায় নেই জবাবদিহির, কারণ, কেউই তাঁদের ভোট দেয়নি। তবে তাঁরা নির্বাচিত হয়ে গেছেন ঠিকই।

কারণ, নির্বাচন কমিশন সে মতো ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগেরই যাঁরা মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন, সেখানে নৌকাপ্রাপ্তরা নয়, নৌকাবিরোধীরাই বেশ ভালো ফল করেছেন। এ পর্যন্ত বিজয়ী ৪৪ শতাংশ চেয়ারম্যানই হচ্ছেন স্বতন্ত্র; অর্থাৎ তাঁরা নৌকাকে ফেল করিয়ে দিয়েছেন। আরও বড় ঘটনা হচ্ছে সহিংসতা। নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তার মধ্যেও সহিংসতার ঘটনা নিয়মিতই ঘটেছে। ক্ষমতাসীনদেরই তো দায়িত্ব অরাজকতা রোধ করা; কিন্তু তাঁদের মানসিকতায় আর যা কিছুরই প্রাচুর্য থাকুক সহনশীলতা যে নেই, তা কাজে ও কথায় প্রকাশ পায়। অনেক সময় কথাও আভাস দেয় কাজে তা কেমন রূপ নেবে। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি নির্বাচনী প্রচার সভায় জনতাকে উদ্দেশ করে ছাত্রলীগের এক নেতার উক্তি: ‘নৌকার বিপক্ষে একটা ভোট পড়লে ওই ওয়ার্ডে লাশ পড়বে পাঁচটা, ইনশা আল্লাহ।’ (দেশ রূপান্তর, ২৭. ১১.২১)। কথাটা ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় এবং পুলিশি ঝামেলা ঘটতে পারে ভেবে, বক্তা অবশ্য পরে আত্মগোপনে গেছেন। কিন্তু আওয়াজটা একটু বেসামাল হলেও ভেতরের সারবস্তু যে মিথ্যা, এমন তো নয়। ২৯.১১.২১ তারিখের খবর: ‘সহিংস ভোটে ৯ মৃত্যু; আহত দেড় শতাধিক। গুলিবর্ষণ, ককটেল হামলা, বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান। শার্শায় আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর ভোট বর্জন’। (সমকাল) পরের দিনের খবর ‘ভোট-পরবর্তী সহিংসতায় ৫ জন নিহত’। (দেশ রূপান্তর)।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ