হোম > ছাপা সংস্করণ

একুশ শতকের একুশের বিদায়, স্বাগত বাইশ

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

আজ রাত ১২টায় শেষ হবে এই শতকের ২১ সাল, ঠিক এক মিনিট পরেই শুরু হবে নতুন একটি বছর—২০২২। এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এই অনুভূতিসচেতন যেকোনো মানুষকে নাড়া দিয়ে যায়। প্রথম অনুভূতিটি ৩৬৫ দিনের একটি বছরের বিদায়ের। দ্বিতীয় অনুভূতিটি পরবর্তী ৩৬৫ দিনের নতুন একটি বছরের সূচনালগ্নের। প্রথমটি এক বছরের নানা অভিজ্ঞতায় জানা দিনগুলোর কথা। দ্বিতীয় অনুভূতিটি শুধুই প্রত্যাশার নানা অজানা এক ভবিষ্যতের পথচলার স্বপ্ন দেখা। প্রতিবছরই মানুষ এমন এক সন্ধিক্ষণে উপনীত হয় যখন পেছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করা ফেলে আসা বছরটি ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ অর্জন ও ব্যর্থতার মতোই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৩৬৫ দিনের হিসাবনিকাশ অনেকটাই জানা থাকে।

একইভাবে নতুন বছরটিতে ব্যর্থতার ছোঁয়া যেন স্পর্শ না করতে পারে, জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বসভ্যতা সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক—সেই প্রত্যাশা আর কামনাই সর্বত্র উচ্চারিত হতে থাকে। কিন্তু বছর শেষে অতীতের নিয়মেই সুখ-দুঃখ, অর্জন ও ব্যর্থতার নানা সূচক অতিক্রম করেই আরেকটি নতুন বছরের নতুন প্রত্যাশায় জীবনকে ভরে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই পুরাতনকে বিদায়, নতুনকে স্বাগত জানানো। এর ব্যতিক্রম নয় আজকের বিদায়ী বছরটিও এবং নতুন বছরকে বরণ করতে যাওয়ার মুহূর্তও। তবু বছর শেষে ফিরে দেখা হয় ফেলে আসা এক বছরের বাস্তবতাকে। কামনা করা হয় নতুন বছরটি যেন হয় ফেলে আসা বছরের চেয়েও বেশি সুখ ও সমৃদ্ধির। আজ সবাই আমরা ২০২১-এর একটি সালতামামি করব এবং নতুন ২২ সালকে নতুনভাবে বরণ করে নেব।

যে বছরটি আজ বিদায় নিতে যাচ্ছে, সেটি আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। ২১ শতকের ২১ সালটি শুধুই ইতিহাসে জায়গা করে নেবে। সামনে আর কোনো দিন এমন একটি শতকের যেমন আবির্ভাব ঘটবে না, সালটিও এই শতকের ইতিহাসেই শুধু যুক্ত হয়ে থাকবে। শত বছর পর বছরটি আসবে নতুন শতাব্দীর সঙ্গে, নতুন বাস্তবতা নিয়ে। তখন মানবসভ্যতার অর্জন ও সমৃদ্ধি কোথায় চলে যাবে, সেটি এখন আমরা কল্পনাও করতে পারব না।

আগামী বছরটিও এর ওপরে সমৃদ্ধির ভর করে দাঁড়াবে। এভাবেই বছর, দশক ও শতক হয়ে সহস্রাব্দের ইতিহাসের পিরামিড মানবসভ্যতার জন্য নির্মিত হয়ে থাকবে। সুতরাং ইতিহাসের প্রতিটি দিন, ক্ষণ ও বছর ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায় না; বরং ইতিহাসেরই অন্তর্গতকালের সাক্ষী হয়ে বিরাজ করে। বছরটি শুরু হয়েছিল করোনা সংক্রমণের এক অতিমারির বাস্তবতার মধ্য দিয়ে। সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদেরও জাতীয় এবং ব্যক্তিগত জীবন ২০২১-এর শুরু থেকে শেষ অবধি নানা অভিজ্ঞতায় অতিক্রান্ত হয়েছে। করোনার নতুন ধরন ডেলটা এপ্রিল-মে মাস থেকে ভয়াবহ আগ্রাসী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হতে থাকে। করোনার এই ভ্যারিয়েন্টটি ২০২১ সালে সারা পৃথিবীর মতো আমাদেরও ভীষণভাবে আতঙ্কগ্রস্ত করে। ছড়িয়েছে গ্রাম ও শহরের প্রায় সর্বত্র। অনেক প্রিয়জনকে আমাদের হারাতে হয়েছে। সেই তালিকা বেশ বড় হয়েছে।

করোনা সংক্রমণে জর্জরিত হয়েছে অসংখ্য পরিবার। অনেকেই আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এক ভয়ানক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। কেউ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন, কেউ ফেরেননি। এমন পরিস্থিতি সারা বিশ্বেই ২০২১ সালব্যাপী ঘটতে দেখা গেছে। প্রায় ১০০ বছর এমন দৃশ্য পৃথিবীর মানুষ দেখেনি, এমন কঠিন সংকটেও পড়েনি। মৃত্যু, অক্সিজেনের জন্য হাহাকার, করোনার থাবা, আকস্মিকভাবে প্রিয়জনদের হারানো, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে বিপর্যয়—এই সবই ছিল গোটা বছরের স্বাভাবিক চিত্র।

ঘরবন্দী জীবন, মাস্ক পরে চলাচল, সংকুচিত কর্মজীবন, শিক্ষাব্যবস্থা, মাঝে মাঝে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির থাবা জীবন-জীবিকা যেন মুহূর্তের মধ্যেই বদলে গেছে, গোটা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ, যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে, বাইরে নিরাপদে চলাফেরা, মানুষে-মানুষে মেলামেশা, কাজকর্ম করা, স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। মানুষ কখনো ভাবতে পারেনি অদৃশ্য, অতিক্ষুদ্র ভাইরাস পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান শক্তিশালী মানবপ্রাণীকে এতটা কাবু করে দেবে।

করোনা আমাদের অনেক কিছুই লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। আগস্ট পর্যন্ত আমাদের জীবন করোনাভাইরাসের ঢেউয়ে ওঠানামা করেছে। এরপর ধীরে ধীরে উন্নতি, জীবনে ফিরতে থাকা গতি আবার আমাদের সম্মুখে এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখিয়েছে। মানুষ ফিরতে শুরু করেছে নিজের কাজে, আয়-উপার্জনে, দেশের অর্থনীতির চাকা মন্থর গতি থেকে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে থাকে।

শিক্ষাব্যবস্থা বলতে গেলে ২০২০-২১ সালে বন্ধই ছিল। অক্টোবর মাসে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা খুলতে থাকে। এখনো শিক্ষাজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। তবে করোনার অতিমারিতেও আমাদের অর্থনীতি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। গ্রামের কৃষি অর্থনীতি সচল থাকায় খাদ্যসংকট তীব্র হতে পারেনি। গার্মেন্টস শিল্প অতিমারির থাবার পর ধীরে ধীরে সচল হতে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্য চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে। আমাদের রেমিট্যান্সপ্রবাহ যেভাবে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেভাবে হ্রাস পায়নি। অসংখ্য প্রবাসী নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করেও কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সব ঝুঁকি নিয়েছে। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য মানুষকে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে দেখা গেছে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। বাংলাদেশ অল্প কয়েক মাসের মধ্যে অনেকটাই যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে। দেশের আমদানি-রপ্তানি অতীতের চেয়ে দ্রুতগতিতেই বাড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশে উন্নীত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ অন্যতম ৫টি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। সবচেয়ে চমকপ্রদ সুসংবাদটি দিয়েছে জাতিসংঘ। এ বছর আমরা অর্জন করেছি উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা।

বাংলাদেশ আর্থসামাজিক নানা উন্নয়ন সূচকে করোনার এই অতিমারিকালেও নিজের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ধরে রাখতে পেরেছে। এ বছরই ৬৬ হাজার ১৮৯টি গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ১ লাখ পরিবারকে ঘর দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য বেশ বড় অর্জনের বিষয়। এর মাধ্যমে করোনার ভয়াল থাবার পরও বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার পথ থেকে ছিটকে পড়েনি, তারই বড় প্রমাণ। দেশে কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নও থেমে নেই।

করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, সমাজে দুর্বৃত্তায়িত গোষ্ঠীর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি মার্চে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও তাণ্ডব চালিয়েছে। আবার শারদীয় দুর্গোৎসবে এই অপশক্তি দেশে পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মানুষ হত্যা এবং দেশে রক্তাক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিকল্পিত চেষ্টা করেছিল। তাতে শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই বিনষ্ট হয়নি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর উন্মত্ততা নতুন করে জানান দিয়েছে।

এই বছর স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও চলছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। দেশের রাজনীতিতে আদর্শের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। আগামী দিনে এর অবসান ঘটানোর পথ খুঁজতে হবে। বছরটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর নানা আয়োজনে পালিত হয়েছে। বাংলাদেশ ২০২১ সালে এত সংকট ও সমস্যা মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৫০ বছর পালন করেছে আপন মহিমায়। আজ রাত ১২টা ১ মিনিটে যে আতশবাজি বর্ণচ্ছটায় আকাশ রাঙিয়ে উঠবে, তা যেন নতুন বছরটিকে করোনার ওমিক্রন অতিক্রম করতে পথ দেখায়।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ