মৃণাল সেন একবার এসেছিলেন ঢাকায়। সেটা ছিল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক উৎসব। সেই অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। উৎসবের উদ্যোক্তারা দেশি-বিদেশি প্রতিনিধিদের সম্মানে একটি চায়ের আসর করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হকের বাড়ির উঠোনে। খুব জমে উঠেছিল সেই আড্ডা। তবে ধীরে ধীরে যখন আসর এসে পৌঁছাল শেষ প্রান্তে, তখন অতিথিরা একে একে বিদায় নিতে শুরু করলেন। একটি রঙ্গনগাছের পাশে তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন মৃণাল সেন। পাইপে টান দিচ্ছিলেন। আশপাশে কেউ ছিল না তখন। একাই ভাবছিলেন কিছু। সৈয়দ হকের নজরে পড়ল তা। তিনি সঙ্গ দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘একা হয়ে গেছেন?’
ঈষৎ হাসলেন মৃণাল সেন। পাইপ সরিয়ে নিলেন মুখ থেকে এবং বললেন, ‘এই তো! কে একা নয়?’
মৃণাল সেনের আদিবাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুরে। স্বভাবতই সৈয়দ হক প্রশ্ন করলেন, ‘ফরিদপুরে এ যাত্রায় যাচ্ছেন না, দেশের বাড়ি দেখে আসতে?’
দুই কীর্তিমানকে পাশাপাশি দেখে ততক্ষণে এগিয়ে এসেছিল আরও কয়েকজন। যেকোনো আলোচনায় ঢুকে পড়ার লোক সব সময়ই থাকে। তাঁদেরই একজন এ কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘হাজার হোক দেশের বাড়ি, একবার তো যাবেনই।’
কিন্তু এরপর মৃণাল সেন বললেন একেবারে ভিন্ন এক কথা। ‘যাব, তবে যেতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমি নস্টালজিয়া বা সেন্টিমেন্টে বিশ্বাস করি না। আই লিভ ইন ইনস্ট্যান্ট প্রেজেন্ট, আমি নগদ বর্তমানে বাস করি।’
এরপর তার ব্যাখ্যা করলেন এভাবে: নস্টালজিয়ার খপ্পরে যদি পড়ি, তো নতুন কিছু নেব কী করে? পৃথিবীর যেখানেই যাই, আমি মনে করি, সেখানেই আমার আপন আছে, সেখানেই আমার জীবন, আমার গ্রহণ, আমার অস্তিত্বের ক্ষেত্র।
জীবনকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ায় এ ভাবনাটি তখন ছড়িয়ে যায় উপস্থিত মানুষদের মাথায়। একা মানুষ ছড়িয়ে থাকেন সর্বত্র–ভাবনা হিসেবে মোটেই সহজ কিছু নয়।
সূত্র: সৈয়দ শামসুল হক, হৃৎকলমের টানে, পৃষ্ঠা ১৭৮-১৭৯