হোম > ছাপা সংস্করণ

রাষ্ট্রভাষা ও বাংলাদেশের ভাষা-সমস্যা

কাজী মোতাহার হোসেন

‘…পাঠান রাজত্বে রাজভাষা ছিল পোস্ত আর মোগল আমলে ফারসি। মোগল পাঠানেরা বিদেশি হলেও এ দেশকেই জন্মভূমিরূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং দেশের অবস্থা জানবার জন্য দেশীয় ভাষাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন; বিশেষ করে বাংলাদেশে পাঠান রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রামায়ণ ও মহাভারত সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। তা ছাড়া ভাগবত এবং পুরাণাদিও রচিত হয়। এর আগে বাংলা ভাষা নিতান্ত অপুষ্ট ছিল এবং এ ভাষা জনসাধারণের ভাষা বলে পণ্ডিতদের কাছে অশ্রদ্ধেয় ছিল। তখনকার পণ্ডিতেরা কৃত্রিম সংস্কৃত ভাষার আবরণে নিজেদের সুচিতা ও শ্রেষ্ঠতা রক্ষা করতেন। রাজসুলভ উদারতার সঙ্গে গৌড়ের পাঠান সুবাদারগণ পণ্ডিতদের বিরুদ্ধাচরণ অগ্রাহ্য করতে সাধারণ লোকের সুবিধার জন্য (এবং হয়তো সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরও গল্পপিপাসা নিবৃত্ত করার জন্য) এই সকল পুরোনো রামায়ণ মহাভারত রচনা করান। বলা বাহুল্য, দেশীয় কালচারের ধারা রক্ষা করবার পক্ষে এবং দেশবাসীর নৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আদর্শ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য এই সব পুস্তকের তুলনা নাই। কতকটা এই কারণেই আজ ভারতবর্ষের সামান্যতম কৃষকেরাও এক একজন দার্শনিক বলে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের বিস্ময় উৎপাদন করেছে।

… মোগল যুগে, বিশেষ করে আরাকান রাজসভার অমাত্যগণ বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন। মুসলমান সভাকবি দৌলত গাজী এবং সৈয়দ আলাওল বাংলা কবিতা লিখে অমর কীর্তি লাভ করেছেন।...এরপর এল ইংরাজ রাজত্ব। কিছুদিন ধরে ইংরাজী হলো রাষ্ট্রভাষা। হিন্দুরা সানন্দে নতুন প্রভু ও তার ভাষাকে বরণ করে নিল কিন্তু মুসলমানেরা নানা কারণে তা পারল না। রামমোহনের যুগেও তার উক্তি থেকেই আমরা জানতে পারি, হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের মধ্যে তুলনায় মুসলমানই ভদ্রতার বিচারবুদ্ধি এবং কার্য পরিচালনায় শ্রেষ্ঠ ছিল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই উপরিউক্ত কারণ এবং রাজকীয় ভেদনীতির ফলে আর্থিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক সমুদয় ব্যাপারে মুসলমান তলায় পড়ে গেল এবং হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মনে পরস্পরের প্রতি বিজাতীয় ঘৃণা ও হিংসার সৃষ্টি হলো। বাংলা ভাষাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল। উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিতেরা একে সংস্কৃতের আওতায় নিয়ে কেবল হিন্দুসভ্যতার বাহন করে তুলল। আর মুসলিম অর্ধশিক্ষিত মনীষীরা আরবি-ফারসি বহুল একপ্রকার ইসলামী সাহিত্যের সৃষ্টি করল। দুই দিকেই বাড়াবাড়ি হলো। কিন্তু বিদ্যা, বুদ্ধি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার জোরে পণ্ডিতি বাংলা টিকে গেল, মুন্সিয়ানা বাংলা লুপ্ত হলো। অবশ্য বর্তমান গণপ্রাধান্যের যুগে ক্রমে ক্রমে পণ্ডিতি বাংলাও সরল হয়েছে।’

…ভাষার বাধা একটি জাতিকে কিভাবে পঙ্গু করে রাখতে পারে, তার উদাহরণ তো আমরাই, অর্থাৎ ভারতের হিন্দু-মুসলমান এবং বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরাই। ইংরাজী রাষ্ট্রভাষা হলো এবং শিক্ষার বাহনও হলো। ফলে প্রচুর মানসিক শক্তি ব্যয় করে পাঁচ বছরের জ্ঞান ১০ বছর ধরে আয়ত্ত করবার চেষ্টা হলো; কিন্তু বৈদেশিক ভাষার ফলে সে জ্ঞান ও নিতান্ত ভাসা ভাসা বা অস্পষ্ট হয়ে রইল। ছাত্রদের মুখে উপলব্ধিবিহীন লম্বা লম্বা কোটেশন বা গালভরা বুলি শোনা যেতে লাগল। আরো এক বিষয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল। সে হচ্ছে, ভারতবর্ষে ব্রিটিশের শিক্ষানীতি। বৈজ্ঞানিক বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক এবং পাঠ্যবিষয় এমনভাবে নির্ধারিত হয়েছিল যাতে কার্যকরী শিক্ষার বদলে কতকটা মন বুঝানো মতে পুঁথিগত বিদ্যা আয়ত্ত হয় মাত্র। তাই দেশি বিএসসি, বিএল এবং এমএসসি এমএল-এর সংখ্যা অল্প নয়, অথচ বৈজ্ঞানিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নগণ্য। অবশ্য ইংরাজী শিক্ষায় লাভ যে কিছু হয়েছিল, তা অস্বীকার করা যায় না।

‘ভারতের হিন্দু-মুসলমানের এই সাধারণ পঙ্গুতার উপরেও, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মুসলমানের আড়ষ্টতার আরও দুটি কারণ ঘটেছিল। প্রথমটি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবহেলা আর দ্বিতীয়টি ধর্মীয় ভাষা-সম্পর্কিত মনে করে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষার প্রতি অহেতুক আকর্ষণ বা মোহ। ফলে বাঙালি মুসলমান বাদশাহদের প্রবর্তিত ফারসী সভ্যতা ভুলে গেল আর বাংলা ভাষার সাহায্যেও ইসলামী ঐতিহ্য বজায় রাখবার চেষ্টা করল না। উর্দুর সপক্ষে যতই ওকালতি করা যাক, সেটা যে আসলে পরকীয় ভাষা, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। দেশবাসীর নাড়ির সঙ্গে যোগ না থাকায় উর্দু ভাষার সাহায্যে ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব হয়নি, কারণ ভাসা-ভাসা দু-চারটা বুলির সংযোগে জাতীয় বা ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষা করা বাস্তবিকই অসম্ভব।…

...এই দৈন্য ও হীনতাবোধের আসল কারণ আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে অবহেলা করে ফাঁকা ফাঁকা অস্পষ্ট বুলি আওড়াতে অভ্যস্ত হয়েছি। এই সব কথা আমাদের অন্তর রসে সিঞ্চিত নয় বলেই আমরা কথার মধ্যে জোর পাইনে। বর্তমানে ইংরাজের প্রভাব কমে পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র অতিরিক্ত হিন্দু প্রভাব থেকে মুক্ত মুসলমানের সমবেত চেষ্টায় হিন্দু-মুসলমান ঐতিহ্য পরিপুষ্ট বাংলা ভাষায় রচিত হবার সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। মুসলিম ভাবধারার ঘাটতি পূরণ করে নিয়ে মাতৃভাষাকে পুষ্ট এবং সমগ্র রাষ্ট্রকে গৌরবান্বিত করবার দায়িত্ব এখন আমাদের উপর।’

(কাজী মোতাহার হোসেন, রাষ্ট্রভাষা ও বাংলাদেশের ভাষা-সমস্যা, কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, সম্পাদক, আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলা একাডেমী। সংক্ষেপিত।)

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ