হোম > ছাপা সংস্করণ

ভারতকে হিন্দুত্ববাদে ঢাকার অপকৌশল

গৌতম রায়

আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ এ ধারার অবলুপ্তি ঘটিয়ে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার সমাপ্তি ঘটায়। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে জিতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় সংবিধানকে ধ্বংস করাটাই যে এখন আরএসএস-বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য, আর সেই লক্ষ্যপূরণের ভেতর দিয়েই ভারতকে ‘রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্র’-তে পরিণত করে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দিকে যাচ্ছে, যা তাদের কাজ দেখে ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

ভারতীয় সংসদের নির্মীয়মাণ ভবনের ছাদে একটি বৃহদাকার অশোক স্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। সে উপলক্ষে প্রচলিত হিন্দু আচার অনুযায়ী পুরোহিতদের দ্বারা পূজাপাঠের সঙ্গে ধর্মীয় রীতিতে অশোক স্তম্ভের অর্চনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে। প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড এটাই পরিষ্কার করে দিল, পরবর্তী লোকসভার ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গঠন করলে ভারতের বুকে ঠিক কী কী ঘটতে চলেছে।

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ঘটিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিবর্তিত সংস্করণ সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীরা কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই ভারতের মতো সার্বিক বৈচিত্র্যময় দেশে ধর্মনিষ্ঠার সংজ্ঞাকে বদলে দিয়েছে। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের কালে সাম্প্রদায়িকতাকে ভিত্তি করে ব্রিটিশের দক্ষিণ এশিয়ার বাজার অক্ষুণ্ন রাখতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তিই নিজেদের উদীয়মান বুর্জোয়া আর অভিজাত উচ্চমধ্যবিত্তদের স্বার্থে যখন দেশভাগ করেছিল, তখনো কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মনিষ্ঠা এক বন্ধনীভুক্ত কোনো বিষয় ছিল না। আরএসএস ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করতে স্বাধীনতার পর থেকেই সাম্প্রদায়িকতাকে মূল ভিত্তি করে এগিয়ে চলছে। অর্থনীতিকে নিজেদের তাঁবে আনতে দেশের সামন্ত‍তান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থা এবং নবোত্থিত বুর্জোয়া ও উচ্চমধ্যবিত্তকে কবজা করার চেষ্টা করে চলেছে। বামপন্থীরা এই হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরকে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া সমাজের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, ঔপনিবেশিক যুগের সাম্প্রদায়িকতাকে স্বাধীনতার পর ধর্মের আড়ম্বরের সঙ্গে মিশিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের যে রাস্তা আরএসএস-হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ নিয়েছিল, যার ফসল এখন তুলছে বিজেপি, সেসব সম্পর্কে বামপন্থীদের বাস্তব ধারণা অনেক কম ছিল।

১৯৪৭ সালের আগে সাম্প্রদায়িকতা অপর ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের ক্ষতিসাধনে সম্প্রদায়ভিত্তিক বিদ্বেষকেই সব থেকে বেশি কাজে লাগাত। স্বাধীনতার আগে সাভারকর, হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকর, শ্যামাপ্রসাদ, দীনদয়াল, এন সি চ্যাটার্জি, বলরাজ মাধোক প্রমুখকে অপর সম্প্রদায় সম্পর্কে ঘৃণা, বৈরিতা, বিদ্বেষ ছড়াতে যত সক্রিয় দেখা যেত, তার ভগ্নাংশ সময়ও তাদের ধর্মাচরণের জন্য ব্যয় করতে দেখা যেত না। দেশভাগের পর হিন্দু বুর্জোয়া, উচ্চমধ্যবিত্ত, গজিয়ে ওঠা কলকারখানার মালিক—এসবের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতেই সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করা শুরু হলো মুসলমানের অর্থনৈতিক সীমাকে আরও অনেক বেশি সংকুচিত করতে। আর সেই লক্ষ্যেই সাম্প্রদায়িকতার চরিত্র বদল করে তার সঙ্গে ধর্মনিষ্ঠা নয়, সংযুক্ত করা হলো ধর্মাচরণকে।

হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সাম্প্রদায়িকতার এই নয়া অভিমুখের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করে নিলেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, বসন্ত শ্রীহরি আনে, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, রাজেন্দ্র প্রসাদের মতো কংগ্রেস শিবিরের সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন নেতারা। সাম্প্রদায়িকতার এই চরিত্র বদলে ব্যক্তিবিশেষ খুব একটা বড় বিষয় হয়ে দেখা দিল না। প্রধান বিষয় হয়ে উঠল সম্প্রদায়। সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা সাম্প্রতিককালের ভারতে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে পরিণত হয়। এই আধিপত্যবাদীদের এক-দুজনকে এমনভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরাকাষ্ঠাতে পরিণত করল যে, নরেন্দ্র মোদির নির্মীয়মাণ সংসদ ভবনের ছাদে অশোক স্তম্ভের পূজা ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তাদের সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ নেমে আসার অশনিসংকেত পৌঁছে দিয়েছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় আন্দোলনকালের সাম্প্রদায়িকতাকে অর্থনীতির সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে আরএসএস-হিন্দু মহাসভা একটা নতুন সংজ্ঞাতে উপস্থাপিত করেছিল। পাল্টা হিসেবে কখনো কখনো মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা নখদন্ত বিস্তারের চেষ্টা করলেও সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক সংখ্যাধিক্যে তারা শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারেনি। জওহারলাল নেহরুর পর ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের শাসকেরা নিজেদের ক্ষমতার মসনদ বাঁচাতে এই সাম্প্রদায়িকতাকে কখনো প্রকাশ্যে প্রশ্রয় দিয়েছে, কখনো বা আড়াল থেকে মদদ জুগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নেহরু যেভাবে প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ট্যান্ডন প্রমুখের সাম্প্রদায়িক ঝোঁকের মোকাবিলা করেছিলেন দৃঢ়তার সঙ্গে, তেমনটা আজ পর্যন্ত স্বাধীন ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী করেননি। নেহরুর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ভার দিয়েছিলেন আরএসএসের ওপর। গান্ধী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত সংঘ সেই প্রথম কিন্তু স্বাধীন ভারতে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছিল।

ইন্দিরা গান্ধী নিজের দলের সিন্ডিকেটপন্থীদের শায়েস্তা করতে বাইরের থেকে সংঘের সাহায্য নিতে দ্বিধা করেননি, যেমন করেননি কমিউনিস্টদের সাহায্য নিতেও। আরএসএস যখন স্বাধীন ভারতে সাম্প্রদায়িকতার নতুন পর্যায় হিসেবে নিত্যনতুন পদ্ধতি গ্রামীণ ভারতের ওপর প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল, সেটি ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির অন্যতম ছুঁতো হয়ে উঠতেও দেরি হয়নি।

আজ যেভাবে গোটা দেশকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের অধীন করে ক্রমেই রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে ভারতকে ঠেলে দিচ্ছেন মোহন ভাগবত আর নরেন্দ্র মোদির জুটি, তখন কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাকে অতীতের সব সংজ্ঞা থেকে বের করে এনে ধর্মনিষ্ঠা নয়, ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে সমর্থ হয়েছেন। দেশের সামাজিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে সামাজিক গণমাধ্যম—সর্বত্রই আচারসর্বস্ব ধর্মের এমন একটা আড়ম্বরপূর্ণ চেহারাকে ‘ধর্ম’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে যে অচিরেই সেই আচারসর্বস্বতার আড়ালে থাকা কুসংস্কার, ধর্মের নামে অধর্ম, অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠার বিকৃত ব্যাখ্যা একটা অর্থনৈতিক লোভের মোড়কে মানুষকে অপর ধর্মীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে বিদ্বেষী করে তুলছে। জাতীয় আন্দোলনের সময় যে সাম্প্রদায়িকতা আমজনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না, এমনকি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক লোকদের ইন্ধনে দাঙ্গার পরও, ‘সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি’ পড়ত, তা আর এখন কিছুতেই হচ্ছে না। গুজরাট থেকে বসিরহাট, দিল্লি, তেলিনীপাড়া, হাজিনগর, কাঁকিনাড়া—কোথাও দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভেতরে সেই আগের মতো ‘বিশ্বাস’ ফিরে আসছে না। বিশ্বাস যাতে না আসে, সে জন্যই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বরবাদ করতে জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভকে প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুত্বের মোড়কে ঢাকতে চাইবে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীরা। 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ