খুলনা শিল্পাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জুট মিল ছিল দ্য ক্রিসেন্ট। এক দশক আগেও এই পাটকলের সামনে রাতদিন শ্রমিক-কর্মচারীদের আনাগোনা ছিল। এখন সেটি জনশূন্য। শ্রমিকদের ঘিরে আশপাশে যেসব ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেগুলোরও অধিকাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো আছে সেগুলো চলছে ঢিমেতালে।
শুধু ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয়, ভাড়াটিয়া না পেয়ে বেহাল হয়ে পড়েছে আশপাশের বাসাবাড়িও। দ্য ক্রিসেন্ট কারখানার শ্রমিকেরা এসব বাড়িতে ভাড়ায় থাকতেন।কারখানা বন্ধের পর তাঁদের অনেকে বাসা ভাড়া দিতে না পেরে চলে গেছেন। যেসব সাবেক শ্রমিক এখনো আছেন তাঁদের কেউ কেউ নিয়মিত বেতনের কাজ না পেয়ে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
দ্য ক্রিসেন্টের মতো খুলনার দৌলতপুর জুট মিল, পিপলস জুট মিল, নিউজ প্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিলসহ খুলনার ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ২০২০ সালের জুলাইয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এতে ৩০ হাজারের বেশি স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিক বিপাকে পড়েন। তখন এই ৯টিসহ দেশের ২৬টি পাটকল বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার। গতকাল রোববার এসব কারখানা বন্ধের তিন বছর পূর্তি হয়েছে। দিনটিকে কালো দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ। দিবসটিতে নানা কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি।
নগরীর খালিশপুরের বিএডিসি রোডে দৌলতপুর, পিপলস জুট মিল, নিউজ প্রিন্ট ও হার্ডবোর্ড মিল। সম্প্রতি এ এলাকায় কথা হয় কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও বাসাবাড়ির মালিকের সঙ্গে। বিএডিসি রোডের পাশের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম, আব্দুর রহমান ও শাহিনুল ইসলাম বলেন, পাটকলগুলো যখন চালু ছিল তখন অনেক শ্রমিক-কর্মচারী ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু মিল বন্ধ হওয়ার পর তাঁদের অনেকে ভাড়া দিতে না পেরে রাতের অন্ধকারে চলে গেছেন।
বিএডিসি রোডের তৈয়বা কলোনির মুদিদোকানি রাজ্জাক শেখ বলেন, একসময় দোকানে কয়েক শ শ্রমিক-কর্মচারী সামগ্রী কিনতেন। মাস শেষ হলে বেতন পেয়ে তাঁরা বকেয়া পরিশোধ করতেন। ব্যবসা তখন ভালোই ছিল। কিন্তু কারখানা বন্ধের পর অনেক শ্রমিক বাকিতে সামগ্রী কিনে আর টাকা দিতে পারেননি। কেউ কেউ না বলেই চলে গেছেন।
শিল্প এলাকাটিতে এখনো পাটকলের কিছু সাবেক শ্রমিক পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। সম্প্রতি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাঁরা জানান, পত্র-পত্রিকায় ছবি বা নাম দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে একটি পক্ষ ভয়ভীতি দেখায়।
সাবেক শ্রমিকেরা বলেন, লোকসানের কারণে ২০২০ সালে তিন মাসের জন্য উৎপাদন বন্ধের কথা বলে মিলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখনো চালুর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মিল চালু না হলেও কোয়ার্টারগুলোতে অবস্থান করা শ্রমিকেরা পরিবার নিয়ে কোনো রকমে টিকে ছিলেন। কিন্তু সেখান থেকেও তাঁদের বিতাড়িত করা হয়। এখন তাঁদের দুর্বিষহ এক জীবন কাটছে।
পাটকল সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান বলেন, পাটকলে কাজ করা শ্রমিকেরা অন্য কোনো কাজে তেমন দক্ষ না। এরপরও টিকে থাকার জন্য তাঁরা অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন। অন্যদের মতো তাঁরও দাবি, মিলগুলো আধুনিকায়ন করে আবার সরকারিভাবে চালু করা হোক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক গোলাম রব্বানি বলেন, সরকারিভাবে চালুর কোনো পরিকল্পনা নেই। বেসরকারিভাবে চালুর চেষ্টা করছে সরকার। এরই মধ্যে খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের জন্য টাকা জমা দিয়েছে ফরচুন গ্রুপ। তারা দৌলতপুর জুট মিলের জন্যও টাকা জমা দেবে। স্টার, খালিশপুর, ক্রিসেন্ট, ইস্টার্ন ও কার্পেটিং জুট মিল ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। যশোরের জেজেআই মিল হস্তান্তর করা হয়েছে আকিজ গ্রুপের কাছে।
তবে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল লিজ বা ব্যক্তিমালিকানায় না দিয়ে সেগুলো আধুনিকায়ন করে পুনরায় চালুর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। গতকাল রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড় ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পৃথক কর্মসূচিতে এ দাবি জানায় দলগুলো।