হোম > ছাপা সংস্করণ

সিংহল দ্বীপে সুদিন ফিরুক

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

মধ্যম আয়ের দেশের দাবিদার প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার বিপর্যয় হঠাৎ করে চোখে পড়লেও এর শুরুটা কয়েক বছর আগে হয়েছিল। বৈদেশিক রিজার্ভের ঘাটতি, কৃষিতে ভর্তুকি তুলে নেওয়া, বাণিজ্য ঘাটতি, ঋণের টাকায় এয়ারপোর্ট ও সমুদ্রবন্দর তৈরির মতো মেগা প্রজেক্ট, সরকারি আমলাদের অতিতোষণ, দরিদ্র মানুষের প্রতি তেমন দৃষ্টি না দেওয়া এবং অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দেশটিকে জনরোষের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর এত বড় অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক সংকটে পড়েনি দেশটি। অভ্যন্তরীণ বহু সমস্যা থাকলেও গত বছর থেকে ভয়াবহ বিদ্যুৎ-সংকট শুরু হলে জনরোষের কথা বহির্বিশ্বে প্রচারিত হতে থাকে। এরপর জরুরি ওষুধ, জ্বালানি ও খাদ্যসংকটে নিপতিত হয়ে পড়ে দেশটি। বৈদেশিক রিজার্ভ কমতে কমতে পাঁচ কোটি ডলারে নেমে আসে। জরুরি পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। দেশটি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। শুরু হয় বিক্ষোভ ও সরকার পতনের আন্দোলন। সিংহল দ্বীপের এরূপ ভয়ংকর সহিংসতায় বিচলিত হয়ে উঠছে প্রতিবেশী দেশগুলোর পরিস্থিতি এবং উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে বৈশ্বিক নানা সংকটের।

সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্ষ শুরু হয় ৮ এপ্রিল। শ্রীলঙ্কাজুড়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে পড়ে। কলম্বোর আশপাশে ও রাজপথে সহিংসতা শুরু করে তারা। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের সমর্থকদের ওপর চড়াও হয়ে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনগণ। রাজাপক্ষে পদত্যাগ করেন।

শ্রীলঙ্কায় গত ৯ মে এক রাতেই ৩৩ জন এমপির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ক্ষিপ্ত জনতা। দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করেও গণবিক্ষোভের লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। ১০ মে ভোরের আলো ফোটার আগে রাজাপক্ষে সেনাবাহিনীর প্রহরায় সরকারি বাসভবন ত্যাগ করতে সমর্থ হন। জনতা তাঁর বাসভবন ঘিরে বিরূপ স্লোগান দিচ্ছিল। এরূপ চলে যাওয়াকে অনেকে লজ্জাজনক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর এত দিনের ক্ষমতার দম্ভ হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়াটা যেন জনগণের কাছে বহু কাঙ্ক্ষিত একটা বিষয় ছিল।

১২ মে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ রনিল বিক্রমাসিংহে। কিন্তু তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার পরও ক্ষুব্ধ জনতা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবিতে ১৩ মে রাজপথে উত্তাল মিছিল বের করে। নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল সরকার ও মন্ত্রিসভা নিয়োগের ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছেন।

কেন এমন খারাপ পরিস্থিতি হলো? করোনার প্রভাবে শ্রীলঙ্কায় তেমন কোনো ক্ষতি হতে শোনা যায়নি। ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপ-আমেরিকার মতো করোনার ভয়াবহতা তেমন ফুটে ওঠেনি। মানুষ এ পর্যন্ত সবকিছু সামলিয়ে নিয়েছে। আবার কাজে ফিরেছে। কিন্তু দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে কোন খারাপ ঢেউ বেশি আঘাত করে বসেছে—সেটাই এখন ভাবনার বিষয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবীব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি নানা দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা লাগতে শুরু করে। আমদানিনির্ভর দেশগুলোতে এই ধাক্কা অতিদ্রুত অনুভূত হতে শুরু করে। যুদ্ধের আতঙ্ক শ্রীলঙ্কার দুর্বল অর্থনীতির ওপর ধাক্কার সেই তরঙ্গকে প্রলম্বিত ও বেসামাল করেছে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন। শ্রীলঙ্কান রুপি ডলারের বিপক্ষে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক খাদ্য আমদানির জন্য ৬০ কোটি ডলার সহায়তা দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শ্রীলঙ্কান রুপির দুর্বলতা কাটানোর জন্য অর্থনীতিবিদেরা এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও হংকংয়ের মতো বিশেষ মুদ্রাবোর্ড গঠন করে ‘শক থেরাপি’ বৈদেশিক বিনিময় হার সামলানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তার আগেই জনরোষের মধ্যে পড়ে তাদের মাথা গুলিয়ে গেছে। অর্থনীতি সামলানোর দিকে না গিয়ে পুলিশি দমন-পীড়নের মাধ্যমে জনরোষের আন্দোলন ঠান্ডা করতে গিয়ে তিনি নিজের পতন ত্বরান্বিত করেছেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। কারণ, জনদুর্ভোগ বেড়ে গেলে এবং মৌলিক চাহিদা ক্রমাগত অপূরিত থাকলে মানুষ বিগড়ে যায়। এসব সমস্যা শক্ত ভূমিকা নিয়ে মোকাবিলা করতে না পারলে এই বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

দমন-পীড়নের ভয়ে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যরা এত দিন ঘুমিয়ে ছিল। তারা এই সুযোগে মাথা চাড়া দিলে সহিংসতা আরও বেড়ে যেতে পারে; বিশেষ করে পরাস্ত তামিলরা পুনরায় জেগে উঠতে পারে। মুসলিম সংখ্যালঘুদের নানাভাবে অত্যাচার করা হয়েছিল। তামিল, খ্রিষ্টান, মুসলিম কেউই শ্রীলঙ্কাকে নিজের দেশ মনে করে না বলে বহু আগে সংবাদ বের হয়েছে। একসময় মুসলিমরা শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য টাইকুন ছিল। তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বহির্বিশ্বে সে সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রভূত ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তারা এখন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কোণঠাসা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজাপক্ষে পরিবারের লোকজন সরকারি আনুকূল্য পেয়ে অর্থের পাহাড় গড়েছেন। আমলারা দুর্নীতিবাজ হয়ে অর্থ পাচার করেছেন। নিজেদের তেমন বিমান বা সমুদ্রগামী জাহাজ নেই; কিন্তু ঋণের অর্থে বড় বড় বিমান ও নৌবন্দর তৈরি করেছেন। তাঁদের সবচেয়ে বড় দাতা চীন ও জাপানের সতর্কবাণীকে কর্ণপাত না করে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার জন্য সেসব দেশ এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এসব নানা অনিয়মের ফাঁদে শ্রীলঙ্কাবাসী এখন চরম সংকটের মুখে দিনাতিপাত করছে।

করোনার অব্যাহত সংক্রমণ ও অবিরত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অসন্তোষের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কার খারাপ ঘটনাকে সবাই উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এতে দেশে দেশে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণকারী সরকারগুলোর টনক নড়ে উঠে যারপরনাই উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।

জনগণ কতটা ক্ষুব্ধ হলে এমপিকে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে অথবা মন্ত্রীর বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিতে পারে, তা সত্যি অনুমান করা কঠিন ব্যাপার। এখন জনরোষে উত্তাল শ্রীলঙ্কা, বঞ্চিত মানুষজন বেপরোয়া ও ক্ষুব্ধ। দেউলিয়া অর্থনীতির জাঁতাকলে পড়া দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলাও বেশ কঠিন।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সবার সমানভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে মানুষ যা ভাবে তা বাস্তবে সৃষ্টি করতে পারে না। ফলে ব্যক্তিগত কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়ে সমষ্টিগত উন্নয়নের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। এভাবে লুটেরাশ্রেণি তৈরি হয় এবং ধ্বংস করে অর্থনীতি, ভেঙে ফেলে চিরায়ত সামাজিক কাঠামো ও বন্ধন। এগুলোর প্রতি উদাসীনতা অবহেলায় জনরোষ সৃষ্টি হয়; যা ডেকে আনে করুণ পরিণতি। শ্রীলঙ্কায় এর বেশি কি কিছু ঘটেছে? শ্রীলঙ্কার মানুষ ন্যায়বিচার চায়, তারা রাজনৈতিক খেলা পছন্দ করছে না। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য একটি নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়। এ জন্য শ্রীলঙ্কার বঞ্চিত মানুষ বিচলিত, উৎকণ্ঠিত। তাদের আন্দোলনের উত্তাপ গোটা বিশ্বকে উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে উল্লিখিত বিষয়গুলোর সমাধান না করে সংকটাপন্ন শ্রীলঙ্কার ‘শ্রী’ দ্রুত ফেরাতে কত দিন লাগবে, তা বেশ ভাবনার বিষয়। আমরা চাই ঐতিহ্যবাহী সিংহল দ্বীপে অতিদ্রুত সুদিন ফিরে আসুক।

লেখক: সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ