বাংলাদেশের ব্যবসা ও শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের একটি সাংগঠনিক চর্চা এই যে সুযোগ পেলেই নানা অছিলায় তাঁরা সরকারের কাছে ঋণ ও সুদ মওকুফ, নগদ ভর্তুকি, কর ও শুল্ক হ্রাস, স্বল্পসুদে সহজ শর্তের ঋণ ইত্যাদি বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা ও সুবিধা দাবি করে থাকেন। তবে তাঁদের সবার দাবিদাওয়াই যে সমহারে পূরণ হয়, এমনটি বলা যাবে না। এসব দাবিদাওয়া পূরণে সাফল্যের মাত্রা নির্ভর করে দাবি উত্থাপনকারী শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মধ্যকার কার তদবির কতটা পোক্ত বা কর্তৃপক্ষীয় মহলের সঙ্গে তাঁদের কার যোগাযোগ কতটা শক্তিশালী, তার ওপর। যেমন পরিবহন মালিকদের দাবিদাওয়া প্রায় কখনোই বিফলে যায় না, পোশাক খাতের মালিকদেরটাও না। নির্মাণ খাত হয়তো কখনো পায় আবার কখনো খানিকটা ভোগে; তবে শেষ পর্যন্ত তাদেরটাও টিকে যায়। আর যেসব সংগঠনের সঙ্গে দাবিদাওয়া পূরণকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নিজেদেরই স্বার্থ জড়িত, তাঁদের দাবি পূরণের হার শতভাগকেও ছাড়িয়ে যায়। মোটকথা, যে উদ্যোক্তাদের সংগঠন আছে, দেশশাসনের প্রয়োজনে সরকার তাঁদের প্রতি এতটাই উদার যে জনগণের করের অর্থ থেকে তাঁদের প্রত্যেকের জন্যই কিছু না কিছু প্রণোদনা বণ্টন হয়েই যায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁদের কোনো সংগঠন নেই; যেমন কৃষকের, তাঁদের কী হবে? তাঁদের দাবিদাওয়া কে তুলে ধরবে? কিন্তু সংগঠনের অভাবে তাঁদের দাবিদাওয়া প্রকাশ্যে বা সরকারের কাছে তুলে ধরার কেউ না থাকলেও তাঁদের বাস্তব প্রয়োজন তো অস্বীকার করা যায় না। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হচ্ছে কৃষকের বা অনুরূপ অসংগঠিত শ্রেণির মানুষদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর ব্যাপারে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু গত ৫০ বছরে রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান কি এ কাজটি করেছে বা করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কোনো আগ্রহ বা দায়বোধ করেছে? জানামতে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটিরই কৃষক সংগঠন আছে। কিন্তু সেই কৃষক সংগঠনের পক্ষ থেকে কৃষকের স্বার্থে কখনো কোনো দাবিদাওয়া সরকারের কাছে উত্থাপিত হয়েছে—এমনটি জানা যায় না। এর মানে, রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক দল কেউই এই অসংগঠিত, অনগ্রসর শ্রেণি ও পেশার মানুষদের অর্থনৈতিক ও পেশাগত অধিকারের ব্যাপারে ন্যূনতম পর্যায়ের সহানুভূতিও পোষণ করে না। অথচ এ বিষয়ে সংবিধান রাষ্ট্রের ওপর দায় আরোপ করেছে এই বলে যে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’ (সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৯.১)। কিন্তু বিভিন্ন আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা বরাদ্দের ক্ষেত্রে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা বা পরিবহনমালিকদের প্রতি রাষ্ট্র যেরূপ সহানুভূতিশীল আচরণ করছে, সেই একই আচরণ কি কৃষক বা সংগঠনবিহীন সাধারণ মানুষের সঙ্গে করা হচ্ছে? আর তা না করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পক্ষপাতদুষ্ট পন্থায় আর্থিক প্রণোদনা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিলি করার মধ্য দিয়ে সমাজে দিনে দিনে বৈষম্য বৃদ্ধিকেই কি উৎসাহিত করা হচ্ছে না?
সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করে সমাজের সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শনের উপরিউক্ত প্রেক্ষাপটটি বাস্তব চর্চায়ও কীভাবে হুবহু মিলে যায়, তা উপলব্ধি করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত কিছু সিদ্ধান্তের বিষয় সামনে আনা যেতে পারে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ এবং প্রথম লকডাউন জারি করা হয় ওই বছরেরই ২৩ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত। অবধারিতভাবেই তখন প্রথম উদ্বেগ ছিল লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া আয়হীন মানুষদের জীবিকার বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেটি। কিন্তু লক্ষ করা গেল, সে বিষয়ে সরকার ব্যবস্থা নিলেও সব বিষয় ছাড়িয়ে তাদের অগ্রাধিকার তালিকার একেবারে প্রথমেই চলে আসে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা। সরকার এই প্যাকেজ ঘোষণা করে লকডাউনের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ২৪ মার্চ এবং তখন পর্যন্ত পোশাকশিল্পকে বাড়তি প্রণোদনাদানের মতো কোনো অর্থনৈতিক পরিস্থিতিই তৈরি হয়নি এবং সরকারের কাছে কেউ প্রণোদনা চায়ওনি। অতএব সহজেই বোঝা যায়, সরকারের পক্ষপাতটি কোন দিকে।
দেশের রাজস্বনীতি এখন এমন যে আয় যত বেশি, কর তত কম। ঋণ বিতরণকাঠামো ও নীতিমালা এমন যে গ্রামীণ মানুষকে চরম তাচ্ছিল্যে ডুবিয়ে মূল লক্ষ্য শহরের সদা সুবিধাভোগী উদ্যোক্তা। পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণের মানদণ্ড এমন যে কৃষক ও নিম্ন আয়ের সাধারণের ব্যবহার্য ডিজেলের দাম বেশি থাকে বিত্তবানের ব্যবহার্য অকটেন বা পেট্রলের চেয়ে; আবার সয়াবিন বা বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভোক্তার চেয়ে উৎপাদকের স্বার্থই দেখা হয় সর্বাগ্রে। নগদ প্রণোদনার নীতিমালা এমন যে ‘দরিদ্র’ পোশাকমালিকদের জন্য নগদ প্রণোদনার পরিমাণ বাজেট থেকে বাজেটে বাড়তে থাকলেও দাতাদের পরামর্শে মুক্তবাজার অর্থনীতির নাম করে কৃষকের ব্যবহার্য সার, বীজ ও কীটনাশকের ওপর থেকে আরও বহু আগেই ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। উদাহরণের তালিকা এভাবে যত দীর্ঘ করা যাবে, ততই প্রকট হয়ে উঠবে রাষ্ট্রের বৈষম্যমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিমালা এবং এমন উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যাবে, যেখানে রাষ্ট্রের নীতি কৃষক, শ্রমিক বা নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের পক্ষে গেছে।
ভারতের তিনটি কৃষি আইন সম্প্রতি সে দেশের সংসদ (লোকসভা) প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে কৃষিপণ্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়াসংক্রান্ত। আইনটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে, অর্থাৎ পণ্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমা বহাল থাকায় ভারতের বড় ব্যবসায়ীরা এখন আর ইচ্ছামতো পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারবেন না। সম্পদের মেরুকরণ ঠেকাতে, অর্থাৎ এর বৈষম্যমুখী প্রবণতা রোধে ভারতের পুরোনো আইনটির অনুরূপ একটি আইন বাংলাদেশেও থাকা উচিত বলে মনে করি, যা বর্তমানে নেই। আর তা না থাকার কারণেই অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সুযোগমতো পণ্যের বিশাল মজুত গড়ে তুলছে এবং নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যখন-তখন পণ্যমূল্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে রাতারাতি বিরাট অঙ্কের মুনাফা লুটে নিতে পারছে। আর এর বিপরীতে ভোক্তা ও সাধারণ মানুষ লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির চাবুকে নিয়ত খাবি খাচ্ছে এবং অসহায় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কোনো বাড়তি শ্রম ও বিনিয়োগ ছাড়াই একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী কীভাবে রাষ্ট্রের ভুল নীতির কারণে রাতারাতি অগাধ বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে তারা এটাও দেখছে কীভাবে মফস্বল শহরের একজন সাধারণ চাতালিও মূলত ধূর্ততাকে পুঁজি করে কোনো যোগ্যতা ও সামর্থ্য ছাড়াই রাতারাতি বিশাল ক্ষমতা ও অগাধ পুঁজির মালিক হয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছেন।
উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর কিংবা কৃষি মন্ত্রণালয় কি এ ব্যাপারে একটি নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়ে আদৌ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে? মনে হয় না। কারণ এই রাষ্ট্র বিত্তবানের স্বার্থ সমুন্নত রাখতেই শুধু ব্যস্ত নয়, একই সঙ্গে তাদের (বিত্তবানের) স্বার্থের যাতে কোনো হানি না ঘটে, তারও নিরন্তর পাহারাদার। অতএব বিত্তবানের বা বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থের হানি ঘটিয়ে পণ্যের মজুতের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়াসংক্রান্ত কোনো আইন বাংলাদেশ শিগগিরই করবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে কেন ও কীভাবে বৈষম্য বাড়ছে, তার একটি অতিসংক্ষিপ্ত ইঙ্গিতধর্মী আলোচনা ওপরে টানা হলো; যার উপসংহারে একবাক্যে শুধু এটিই বলা যায়, রাষ্ট্র এখন বিত্তবানের পক্ষে। এই অবস্থার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ নানা অনুষঙ্গের পাশাপাশি পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার একচেটিয়াত্ব ও এককেন্দ্রিকতার দায়ও হয়তো অনেকখানি রয়েছে। কিন্তু আসল সত্য এই যে এই বৈষম্য টিকিয়ে রাখা বা না রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, দুর্ভাগ্যবশত তাদের অধিকাংশের টানটিই সমতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে নয়। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসংক্রান্ত ভবিষ্যৎ নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনাগুলোর চরিত্র ও কাঠামো নির্ধারণে এগুলোর বিদ্যমান বৈষম্যমুখী ধারাই বহাল থাকবে, নাকি তা সাধারণের পক্ষে ঢেলে সাজানো হবে, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা বৈকি! তবে সে ক্ষেত্রে এ বিষয়টিই শুধু সামনে আনতে চাই, শোষণ ও বৈষম্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একটি সমতাপূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মৌলচেতনা এবং তা এ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নির্দেশনাও।