রাশিয়া ও চীন থেকে সমরাস্ত্র কেনা এবং চীনের অর্থায়নে ব্যয়বহুল প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের নেতৃত্বে দুটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের ওয়াশিংটন সফরকালে যুক্তরাষ্ট্র এ সতর্কবার্তা দেয় বলে কয়েকটি কূটনৈতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব গতকাল সোমবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চীন, রাশিয়া, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে’ বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয় আলোচনায় এসেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন তাঁর মার্কিন প্রতিপক্ষ অ্যান্থনি ব্লিনকেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন ৪ এপ্রিল। আর পররাষ্ট্রসচিব দুই দেশের নিরাপত্তা সংলাপে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন ৬ এপ্রিল। এর বাইরে পররাষ্ট্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উইন্ডি শেরম্যান, সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির প্রশাসক সামান্থা পাওয়ার এবং কয়েকজন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান পৃথক বৈঠক করেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সঙ্গে।
এসব বৈঠকে উভয় তরফে আগ্রহ ছিল দু দেশের গত ৫০ বছরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সম্পর্ক কী করে আরও এগিয়ে নেওয়া যায় সে বিষয়ে। এ ছাড়া রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে।
এ ছাড়া নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রকল্প চলমান আছে। এসব ক্ষেত্রে হঠাৎ রাশ টানা সম্ভব নয় বলে আমরা তাদের জানিয়েছি।’
সাবমেরিনসহ বাংলাদেশের যুদ্ধাস্ত্র ভান্ডারের বড় অংশের জোগানদার চীন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে চীনের অর্থায়নে।
বৈঠকগুলোয় জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট, যা জেসমিয়া নামে সাধারণভাবে পরিচিত, এবং অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট, যা আকসা নামে পরিচিত, চুক্তি দু’টি স্বাক্ষরের জন্যও তাগাদা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আধুনিক ও কৌশলগত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বাংলাদেশে বিক্রি ও প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা সহজতর করতে যুক্তরাষ্ট্র তিন বছর আগে এ দুটি চুক্তি সইয়ের জন্য অনুরোধ জানায়। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির সুরক্ষা এবং সামরিক তথ্যাদির গোপনীয়তা রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইনে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে এ দুটি চুক্তি স্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে বলে সে দেশের কূটনীতিকরা জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর আলোকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ শুরু করেছে। এসব সমরাস্ত্রের উৎস বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার মনোযোগী আছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক কিছু তৈরি করে থাকে। আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেখান থেকে কিছু নিতেই পারি।’ সরকার জেসমিয়া চুক্তিটি পর্যালোচনা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর একটি নতুন খসড়া যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি দিয়েছে। ৭৭টি দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি আছে তাদের। দেশের স্বার্থ যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এ চুক্তিটি সরকার হয়তো আগে করতে পারে। তবে তার আগে খতিয়ে দেখতে হবে এর ফলে আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এ চুক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় কি না এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনুপ্রবেশের ঝুঁকি তৈরি হয় কিনা।’ তবে আকসা শিরোনামের চুক্তি স্বাক্ষর করা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারে নেই বলে তিনি জানান।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর কৌশলপত্রের (আইপিএস) আওতায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা কাঠামো গড়ে তোলা সম্পর্কিত একটি ধারণাপত্র যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে হস্তান্তর করেছে। সাগর-মহাসাগরে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার বিস্তার কমানোসহ এ কাঠামোর অর্থনৈতিক কিছু ধারণার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চিন্তার মিল রয়েছে। তবে সরকার এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব একটি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর নীতি প্রণয়ন কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং অচিরেই তা প্রকাশ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শ্রমমান ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের সংকট এবং জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলোর ওপরও জোর দেন। তবে এসব বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের অন্যতম আগ্রহ ছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে তদবির করা। এ নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় আরোপ করলেও তা প্রত্যাহারে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। সেখানে আইনিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে হবে জানিয়ে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় আসেনি বলে এ ক্ষেত্রে ফল হয়তো প্রত্যাশা অনুযায়ী তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে না। একটু সময় লাগবে। দেশের ভেতরেও এ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে দৃশ্যমান কিছু উন্নতি আনতে হবে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আইনজীবীরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন বলে তিনি জানান।
প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই উভয় পক্ষ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফেরত নিতে সে দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের চাপ অব্যাহত রাখার বিষয়ে একমত পোষণ করে। এ ছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি এম এ রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্তিকে দু দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হিসেবে উল্লেখ করে তাঁকে দ্রুত ফেরত পাঠাতে বলেছে বাংলাদেশ। তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়বিষয়ক মামলাটি পুনরায় পর্যালোচনা চলমান রয়েছে বলে বৈঠকে বাংলাদেশকে জানায় যুক্তরাষ্ট্র।