২০২১ সালে এসে কোনো এক তরুণ যদি প্রশ্ন করে, কী ঘটেছিল একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর, তাহলে অনেকেই ঠিক উত্তরটি দিতে পারবেন না। পারবেন না, কারণ জাতির সেই চরম ভয়াবহতা নিয়ে মানুষের আবেগ কাজ করে বটে, কিন্তু সত্যিই কী ঘটেছিল, তা জানার চেষ্টা নেই বললেই চলে। মুক্তিযুদ্ধের পর পঞ্চাশ বছর কেটে গেল, কিন্তু বহু প্রশ্নই রয়ে গেল অমীমাংসিত।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়েও সে রকম কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে মানুষের মনে।
দুই. শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে যে উত্তরটি সাধারণত পাওয়া যায়, তা হলো–পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী আর আলবদররা ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় অবস্থানরত বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারপর বিভিন্ন সময় তাঁদের হত্যা করা হয়।
এ ভাবনাটি অজ্ঞতার ফসল। ১৪ ডিসেম্বর যে একটি প্রতীকী তারিখ, সেটা অনেকেই জানেন না। এর আগে থেকেই বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। তবে হ্যাঁ, ১৪ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করা হয় বলে দিবস হিসেবে এ দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই নৃশংসতার পটভূমি সম্পর্কে ধারণা না থাকলে বুদ্ধিজীবী দিবসের গুরুত্ব বোঝা যাবে না। মনে হবে, হঠাৎ করে বেছে বেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শুধুই ১৪ ডিসেম্বরে। এটা যে সুদূরপ্রসারী দুরভিসন্ধির ফসল, সেটা তাতে ঢাকা পড়ে যায়।
তিন. একাত্তরের নয় মাস ধরেই বাঙালি নিধনযজ্ঞ চলেছে। শুধু বাঙালি নয়, এই ভূখণ্ডে যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস, তারাও এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। মার্চ থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। ভুলে গেলে চলবে না, পঁচিশে মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের সময় আরও অনেকের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছিল। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনো সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে নামেনি। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য বড় কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। সে সময় পাকিস্তানিরা নির্বিচারে মানুষ মেরেছে। কিন্তু জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়টা ছিল অন্য রকম। এ সময়টিকে বলা হয় ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়ে পাল্টা আঘাত হানতে শুরু করেন। দেশে অবস্থানরত সাড়ে ছয় কোটি মানুষ সুযোগ পেলেই মুক্তিবাহিনীর জন্য বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। ফলে আরও বেশি নৃশংস হয়ে ওঠে পাকিস্তানি বাহিনী। ছোট কোনো সূত্র পেলেই তারা পাকড়াও করতে শুরু করে গ্রামবাসীকে, হত্যা করতে থাকে। তারা তাদের সহযোগী দালাল শান্তি কমিটি, রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ‘খোঁজ ও খতম’-এর পরিকল্পনা করতে থাকে। রাজাকার সদস্যদের বেশির ভাগ ছিল অশিক্ষিত। কিন্তু ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে যে আলবদর বাহিনী গঠিত হয় সেপ্টেম্বরে, তারা ছিল শিক্ষিত। শিক্ষিত-অশিক্ষিত দালালেরা তখন পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়ক হয়ে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে।
যুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক সচিব রাও ফরমান আলী বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা তৈরি করেন। এই তালিকায় দেশের অনেক প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীর নাম ছিল। আলবদর সদস্যরা এই তালিকায় আরও অনেক নাম যুক্ত করে।
চার. মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন যাঁরা, শুধু তাঁদের নাম এই তালিকায় ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগপর্যন্ত যাঁরা বিভিন্নভাবে জাতীয় আন্দোলনের রসদ জুগিয়েছেন, তাঁদের সবাই ছিলেন এই তালিকায়। এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের তালিকা। শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিকিৎসকসহ বহু পেশার মানুষকেই হত্যার তালিকায় রাখা হয়েছিল।
এ কারণেই দেখা যায়, ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল হানাদারদের অনেক যাচাই-বাছাইয়ের ফল, আলবদরদের মাধ্যমে তালিকাকে আরও সুচারু করায় ডিসেম্বরে তা হয়ে ওঠে বাঙালিকে মেধা ও মননশূন্য করার শক্তিশালী অস্ত্র। ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাঁরাই, যাঁরা বহুদিন ধরে দেশের সংস্কৃতি, ভাষা, স্বাধিকার আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন।
পাঁচ. নভেম্বরের শেষ দিক থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল কমে যেতে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর ঝটিকা আক্রমণ তাদের ভয় বাড়িয়ে দেয়। রাজাকারদের মনেও ভয় এসে বাসা বাঁধে। ঢাকা শহরে ক্র্যাক প্লাটুনের হামলা এই ভয়কে আতঙ্কে পরিণত করে। এরপর ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মিলে যে যৌথ বাহিনী গঠিত হলো, তার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আমেরিকা আর চীনের সাহায্যের আশায় বসে থাকেন। এরপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া একের পর এক ভেটো পাকিস্তানকে নিঃস্ব করে তোলে। পাকিস্তান বুঝে যায়, এই ভূখণ্ডকে আর দখলে রাখা যাবে না।
তখনই পাকিস্তানি বাহিনীর অফিসার আর আলবদরদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে যায়। তারা একের পর এক বৈঠক করে ঠিক করে, পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলবদররা থাকবে বুদ্ধিজীবীদের চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। ১০ ডিসেম্বর দিনের বেলায় রাও ফরমান আলী পিলখানায় গিয়ে কাদালেপা মাইক্রোবাসগুলো দেখে আসেন। সে রাতেই এই শকুনের দল বেরিয়ে পড়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নেই তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে তারা প্রথম আসে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করতে, এরপর সৈয়দ নাজমুল হক আর আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে। পরদিন তারা অপহরণ করে নিজামুদ্দীন আহমদকে। এবং তার পরদিন ১৩ ডিসেম্বর অপহৃত হন সেলিনা পারভীন। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁদের অপহরণ করা হয়েছে, তাঁদের সবাই ছিলেন সাংবাদিক। সাংবাদিকদের প্রতি যে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রোশ ছিল, সেটা বোঝা যায় মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের সময়টিতেই। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও দ্য পিপলস পত্রিকায় গোলা ছুড়ে অফিসগুলো ভস্মীভূত করেছিল। তাই প্রাথমিক ক্রোধের শিকার হলেন সাংবাদিকেরা। শহীদুল্লা কায়সারও সাংবাদিক। তাঁকে অপহরণ করা হয় ১৪ ডিসেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষককে অপহরণ করা হয় এই দিনটিতেই। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রাশীদুল হাসান, আনোয়ার পাশাসহ অনেকেই এদিন অপহৃত হয়েছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর অপহৃত হন চিকিৎসক ফজলে রাব্বি এবং আলীম চৌধুরী। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে অপহৃত হন ড. আবুল কালাম আজাদ।
সব বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা গেল না। কিন্তু তাঁরা সবাই অকুতোভয়ে নিজ জাতি, স্বাধিকার আন্দোলন, জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এবং এই দেশপ্রেমই ছিল পাকিস্তানি ও তাদের দালাল রাজাকার-আলবদরের কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধ।
তালিকায় থাকা সবাইকে হয়তো খুঁজে পায়নি শ্বাপদেরা, কিন্তু যেটুকু ক্ষতি তারা করতে পেরেছিল, সেই শূন্যতা ছিল অসীম।
ছয়. এই নামগুলোর সঙ্গে শহীদ আলতাফ মাহমুদ, জি সি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাসহ আরও অনেকের নাম যুক্ত হলে দেখা যাবে, এই মানুষগুলো দেশকে নিয়ে ভাবতেন। জাতীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে তাঁদের ছিল অবদান। অবরুদ্ধ নগরীতে বসেই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অংশ নিয়েছেন। শত্রু-পরিবেষ্টিত অবস্থায় সিরাজুদ্দীন হোসেন লিখেছেন ‘এত দিনে’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, যাতে কঠোরভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন, আওয়ামী লীগকে যে কারণে দোষ দেওয়া হচ্ছে, সেই একই দোষে দুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো, তা নিয়ে তিনি লিখছেন ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’; শহীদুল্লা কায়সার গোপনে লিখতে শুরু করেছেন পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে উপন্যাস ‘কবে পোহাবে বিভাবরী’, আনোয়ার পাশা লিখেছেন ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। তাঁদের প্রত্যেকেরই ইচ্ছে ছিল, দেশের ভেতরের ইতিহাসটি লিখবেন। এ জন্য তথ্যও সংগ্রহ করেছিলেন তাঁদের কেউ কেউ। কিন্তু তাঁদের বাঁচতে দেওয়া হলো না।
সাত. পাকিস্তানিরা ঠিক করেছিল, কাদের হত্যা করা হবে। যাঁরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, যাঁরা হিন্দু, যাঁরা আওয়ামী লীগকে কোনো না কোনোভাবে সমর্থন করেছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ডের তালিকায়। অর্থাৎ পাকিস্তানিরা এই বঙ্গে পোড়ামাটি নীতিই নিয়েছিল। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত যে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়, তাতে যাঁরা শহীদ হন, তাঁদের প্রত্যেকেই হতে পারতেন জাতির দিকনির্দেশক।
বড় দুর্ভাগ্য আমাদের, তাঁদের সেই কীর্তির কথা তুলে আনার জন্য তেমন কোনো গবেষণা চোখে পড়ে না। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে নিরর্থক প্রচারণার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ছিল বুদ্ধিজীবীদের কাজগুলোর সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করানো। কেন তাঁরা অনন্য, সে তো তাঁদের কর্মকাণ্ডেই প্রকাশিত। সেটা প্রকাশ করলেই বরং সত্যিকার অর্থে তাঁদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে। নইলে কয়েকটি অর্থহীন গালভরা বুলি দিয়ে যান্ত্রিকভাবে দিনটিকে স্মরণ করা চলতেই থাকবে। শুরুতে যে কাল্পনিক তরুণের কথা বলেছিলাম, তাঁকে তো প্রকৃত তথ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে অন্য সবকিছুর মতোই এ শুধু লোকদেখানো শোকে পরিণত হবে।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা