হোম > ছাপা সংস্করণ

নেত্রকোনা বোমা হামলার ১৭ বছর

সঙ্গীতা ইমাম

২০০৫ সালে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই এক ভয়াবহ নির্মমতার শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নেত্রকোনা জেলা সংসদ। ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনা শহরের অজহর রোডে উদীচীর কার্যালয়ের সামনে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়েছিলেন আটজন। ১৭ বছর আগের ওই দিনটির কথা মনে হলে আজও উদীচীর কর্মী-বন্ধুদের গা শিউরে ওঠে। সারা দেশই তখন আক্রান্ত ছিল জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবায়। দেশের নানা প্রান্তে আত্মঘাতী হামলা ও মানুষ হত্যার নারকীয় সংবাদগুলো তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ত। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। এর এক বছর আগে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে চালানো হয়েছিল পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা।

সে সময় উদীচীর মতোই যাঁরা এই জঙ্গি-সন্ত্রাসের নির্মম শিকার হয়েছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, প্রতিটি সন্ত্রাসের পেছনেই রাষ্ট্রীয় মদদ ছিল পরিষ্কার। তৎকালীন সরকার, প্রশাসন, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বাঁচানোর অপচেষ্টা করেছে। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ছাড়া ধর্মীয় ও জাতিগত বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপরও চালানো হয়েছিল স্টিম রোলার। আর জঙ্গি-সন্ত্রাসী বাংলা ভাই কিংবা শায়খ আবদুর রহমানের পক্ষে সংসদে দাঁড়িয়ে সাফাই গেয়েছিলেন চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। জামায়াত নেতা ও তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী রাজাকার নিজামী তো বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি’। এক যুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সেই সব নৃশংসতার কথা আমরা আজও ভুলিনি; কোনো দিন ভুলবও না।

২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনা উদীচী কার্যালয়ের সামনে জেএমবির বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছিলেন উদীচীর প্রিয় মুখ খাজা হায়দার হোসেন ও নাট্যব্যক্তিত্ব সুদীপ্তা পাল শেলী। এ ছাড়া নিহতদের মধ্যে ছিলেন মোটর মেকানিক যাদব দাস, রিকশাচালক আফতাব উদ্দিন, রইছ উদ্দিন, গৃহকর্ত্রী রাণী আক্তার এবং জয়নাল। আত্মঘাতী হামলাকারী এক কিশোরও এ দিন নিহত হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন ৯২ জনের বেশি মানুষ। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকাও ছিল নেত্রকোনা (নেত্রকোনা-৪)। কিন্তু এই বোমা হামলা ও মানুষ হত্যার দায়ে জঙ্গিদের বিচার করতে এক যুগের বেশি সময় লেগেছে। কারণ, পরে আমরা জানতে পারি, সে সময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন জঙ্গি-সন্ত্রাসে চারদলীয় জোটের খোদ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীরই মদদ ছিল। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় সে প্রমাণ উঠে এসেছে। আদালত রায়ও দিয়েছেন।

এই যে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় জঙ্গিগোষ্ঠীর বিস্তার ঘটানো, এর নজির আমরা আগেও দেখেছি। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক গণসংগঠন হওয়ার কারণেই উদীচী বারবার স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির হামলার শিকার হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। উদীচীর ১০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী-বন্ধু এতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। আজ এত বছর পেরিয়ে গেল, এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার আমরা পেলাম না। যশোর হত্যাকাণ্ড মামলাতেও বিএনপির তৎকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামসহ ২৪ জনের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে হাইকোর্টে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ নামটি বাদ দেওয়া হয় এবং ২০০৬ সালে এই মামলার ২৩ আসামিকেই যশোরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বেকসুর খালাস দেয়।

যশোর উদীচীর ঘটনাটিকে একটি উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করালাম মাত্র। এ কথা ঠিক যে ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনা উদীচীর ওপর ঘটে যাওয়া নারকীয় সন্ত্রাসের বিচার হয়েছে। পুলিশের করা মামলায় জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই, সামরিক শাখার প্রধান আতাউর রহমান সানি, জেএমবির কমান্ডার আসাদুজ্জামান, সালাউদ্দীন এবং ইউনুসসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছিল।

ইতিমধ্যে সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। কিন্তু যতগুলো জঙ্গি-সন্ত্রাসের ঘটনা তখন ঘটেছিল, তার সবগুলোর বিচার আজও হয়নি। ১৯৯৯ সালে খুলনার আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা, ২০০১ সালে সিপিবির জনসভা, রমনার বটমূল বা গোপালগঞ্জের গির্জায় বোমা হামলা—উদাহরণ দিলে শেষ করা যাবে না। কতগুলোর বিচার পেয়েছি আমরা? হয় বিচার ঝুলে গেছে, না হয় বিচার ছাড়াই আসামির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে।

প্রতিবছর ৬ মার্চ ও ৮ ডিসেম্বর আসে আর শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে নতুন প্রত্যয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। কারণ, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তের গড়ে তোলা উদীচী আমাদের এ শিক্ষাই দেয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা, মানবিক মূল্যবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মনোজগতে বিভাজন রেখা থাকলেই তার কুপ্রভাব পড়ে সমাজে-রাষ্ট্রে। তাই উদীচীর সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মূল সুরই হলো, সব বিভাজনের নিরসন ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

নেত্রকোনা ও যশোর উদীচীর শহীদেরা আমাদের সে সংগ্রামের শপথেই দীক্ষিত করে গেছেন। বাংলাদেশকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও উগ্রবাদীদের ষড়যন্ত্র আজও শেষ হয়নি; বরং নতুন নতুন পন্থায় জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটছে। তাই সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ময়দানেও গ্রহণ করতে হবে নতুন পরিকল্পনা। সেই সঙ্গে অপরাধ দমনের প্রধান যে পন্থা—আইনের প্রয়োগ, তা নিশ্চিত করতে হবে। আইন যদি অকার্যকর থাকে, তবে কেবল সাংস্কৃতিক লড়াই দিয়ে একটি সমাজের সার্বিক পরিবর্তন আসতে পারে না।

লেখক: সঙ্গীতা ইমাম, সহসাধারণ সম্পাদক, উদীচী

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ