ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেট ও আশপাশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণে নাহিদ হোসেন ও মোহাম্মদ মোরসালিন নামের সাধারণ পরিবারের দুই যুবকের করুণ মৃত্যু হয়েছে। নাহিদ একটি কুরিয়ার সার্ভিসে ডেলিভারিম্যান ছিলেন আর মোরসালিন ছিলেন দোকান কর্মচারী। দুজন ছিলেন নিজ নিজ পরিবারের ভরসাস্থল। তাঁদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল দুটি পরিবার এখন চরম অসহায় অবস্থায় পড়েছে।
‘তুচ্ছ’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে দুদিনের অরাজকতায় দুজন মানুষের মৃত্যু হলো, শিক্ষার্থীসহ ৪০ জনের মতো মানুষকে আহত হতে হলো, ১২ জন সংবাদকর্মীকে মারধর করা হলো, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটল, ব্যবসায়ীদের বিপুল ক্ষতি হলো, তীব্র যানজটে হাজার হাজার মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হলো, এসবের দায়দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই। ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ী নেতারা ঘটনায় ‘তৃতীয় পক্ষ’ জড়িত থাকার কথা বলে নিজেদের দায়মুক্ত করতে চাইছেন কি না, সে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। আমরা জাতীয়ভাবেই দোষারোপের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও হকারদের সংঘর্ষ নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধানের চেয়ে সমস্যা নিয়ে বসবাসেই যেন আমাদের সুখ। তাই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী এবং নিউমার্কেট এলাকার দোকান কর্মচারী ও হকারদের সম্পর্কে যেসব অভিযোগ, সেগুলো দূর করার কথা কেউ ভাবেন না। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা চাঁদাবাজি করেন, দাম কম দিয়ে বা না দিয়ে জিনিস কেনেন বা খাবার খান। কিন্তু এই অভিযোগ সব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধ নয়। দুষ্কর্মে জড়িতদের সংখ্যা হাতে গোনা। কিন্তু তাঁরা কোনো না কোনো মহলের সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকেন বলে তাঁরা হয়ে থাকেন বেপরোয়া। আবার ব্যবসাসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা জিনিসপত্রের দাম বেশি নেন, ক্রেতাদের, বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করেন। এটাও অবশ্য সবার বিরুদ্ধে নয়। হকার-দোকানদারদেরও সবাই বেয়াদব নন। কিন্তু যাঁরা মন্দ তাঁদের আচরণ চোখে পড়ে, তাঁদের নিয়ে কথা বেশি হয়। মন্দদের মোকাবিলার জন্য একজোট না হয়ে নিন্দা-সমালোচনার বান বইয়ে দেওয়াও অনেকে দায় সারার একটি সহজ পথ বলে মনে করেন।
তবে এবার যে সংঘর্ষ হলো, তার সূচনা এসব কারণে নয়। এবার যা হয়েছে: গত সোমবার ইফতারের সময় টেবিল পাতা নিয়ে নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেটের ওয়েলকাম ফাস্ট ফুডের কর্মচারী বাপ্পীর সঙ্গে অন্য ফাস্ট ফুডের দোকান ক্যাপিটালের কর্মচারী কাওসারের বাগ্বিতণ্ডা হয়। এর জেরে বাপ্পী ও তাঁর সহকর্মী সজীবের ডাকে ক্যাপিটাল ফাস্ট ফুডের কর্মীদের শায়েস্তা করতে ছুটে আসেন ঢাকা কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাঁরা ক্যাপিটাল ফাস্ট ফুডের কর্মীদের মারধর করেন। একপর্যায়ে ক্যাপিটাল ফাস্ট ফুডের কর্মীরা নিজেদের দোকানের ছুরি, চাকু নিয়ে পাল্টা হামলা চালান। এরপর আহত হয়ে পালিয়ে যায় ঢাকা কলেজ থেকে আসা দলটি। তবে তারা পরে কলেজের আরও ছাত্রদের নিয়ে এসে নিউমার্কেটে ফের হামলা চালায়। বাপ্পীর সঙ্গে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকজনের সখ্যের কথা জানা গেছে।
সোমবার রাতে সংঘর্ষ হওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল থেকে নিউমার্কেট এলাকায় জড়ো হতে থাকেন ব্যবসায়ী-হকার ও কর্মচারীরা। তাঁরা অতর্কিতে ঢাকা কলেজে হামলার পর ব্যাপক পরিসরে সংঘর্ষ শুরু হয়। ঘটনাস্থলে ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম থাকলেও অতি উৎসাহী কিছু লোক সামনে থেকে হামলায় অংশ নেয়। তারা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা কর্মচারীদের সংঘর্ষে অংশ নিতে আহ্বানও জানায়। অনেক কর্মচারী তাণ্ডবে অংশ না নিয়ে ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকায় তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এরই মাঝে একদল লোক হেলমেট পরে তাণ্ডবে অংশ নেয়।
এরপর ২০ এপ্রিল দুপুরে নিউমার্কেট দোকান মালিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেছেন, অ্যাম্বুলেন্সে আক্রমণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনাটিও অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। কোনো ব্যবসায়ী বা ছাত্র এ কাজ করতে পারে না। তাই এ ঘটনায় ‘তৃতীয় পক্ষ’ জড়িত বলে তাঁর সন্দেহ। তবে তিনি জানেন না তারা কারা?
আবার ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেনও গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সোমবার রাতে সংঘর্ষের পর আমরা আমাদের ছাত্রদের বুঝিয়ে নিয়ে আসি এবং ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিল। কিন্তু হঠাৎ করে মঙ্গলবার সকালে মার্কেটের লোকজন এসে আক্রমণ চালায় এবং কলেজের ভেতরেও ঢুকে যায়। এরপরই সমস্যাটি হয়। আর এবার যে ঝামেলা হয়েছে, সেটি তো পুরোটাই নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বিষয় থেকে শুরু। এখানে ছাত্ররা জড়িত ছিল না, জড়িয়ে ফেলা হয়েছে।’
ব্যবসায়ী নেতা ঘটনার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দায় দেখছেন না। ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলছেন, ছাত্রদের জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ছাত্রদের কে, কীভাবে জড়িয়ে ফেলল, সেটা তিনি খোলাসা করে বলেননি। দুজনের বক্তব্য থেকে যে রহস্য তৈরি হয়েছে, তা ভেদ করার দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশ ইচ্ছে করলে অনেক কিছু পারে। আবার তাদের অনিচ্ছার পরিণতিও আমরা জানি। এবার পুলিশ তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে কি না, সেটা দেখার বিষয়। অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রথম দিকে পুলিশ কেন দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে, তারও কারণ বের করা দরকার।
এখন পুলিশ ও গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে উঠেছে বলে শোনা যাচ্ছে। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অতি উৎসাহী হামলাকারীদের পরিচয় নিশ্চিত হতে কমপক্ষে ১০ জন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা কলেজের বেশ কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। ফুটেজ দেখে কয়েকজন সহিংস হকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। একাধিক ফুটেজে ঘুরেফিরে তাঁদের চেহারা দেখা গেছে। সাংবাদিকদের ওপর ও অ্যাম্বুলেন্সে হামলাসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ ও পথচারীকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি নিউমার্কেটে ফাস্ট ফুডের ঘটনায় মারধরের শিকার হওয়ার পর ক্যাম্পাসে ফিরে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে উত্তাপ সৃষ্টি করা তিন ছাত্রকেও চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তাঁরা ঢাকা কলেজের ছাত্র এবং তিনজনই ছাত্রলীগের কর্মী।
এ ঘটনায় রাজনৈতিক ইন্ধন আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ছাত্র-ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘাত বাধিয়ে কে কী ফায়দা হাসিল করতে চাইছিল, তার কারণ খুঁজছে পুলিশ।
তবে ওই এলাকায় ছাত্র ছাড়াও প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল ও পুলিশের অসৎ ব্যক্তিদের একটি চক্র আছে বলে যে কথা শোনা যায়, তারও তথ্যানুসন্ধান প্রয়োজন। পুলিশ ও গোয়েন্দারা যদি এসবের কারণ খুঁজে পায়, তাহলে ভালো। কারণগুলো জানা গেলে তা গোপন না করে প্রকাশ করলে সেটা হবে উত্তম।
ছাত্রদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সমঝোতার ভিত্তিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তবে এই সমঝোতা ও সহাবস্থান যেন টেকসই হয়, তার প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার নজর রাখা দরকার। সাধারণভাবে এটা মনে করা হয় যে ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে কোনো ধরনের যোগসূত্র ছাড়া দেশে এখন কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটে না। বাদানুবাদ, বচসা, মারপিট, খুনোখুনি নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি যাদের হাতে, তারা মুখ লুকিয়ে থাকলে মানুষের অনাস্থা বাড়ে। নিউমার্কেট এলাকার উত্তেজনা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও স্থানীয় সাংসদ শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনসহ আওয়ামী লীগের একজন নেতারও উপস্থিত না হওয়া স্বাভাবিক মনে হয়নি অনেকের কাছে। শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন একজন ব্যবসায়ী নেতাও। মানুষের দুঃসময়ে তাদের পাশে নেতাদের অনুপস্থিতিরই-বা রহস্য কী? তাঁরা কি তবে সুসময়ের বন্ধু?
সর্বশেষ খবর হলো, সংঘর্ষে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মকবুল হোসেন সরদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে একটি মামলা করেছে পুলিশ। সে মামলায় মকবুল ১ নম্বর আসামি।
প্রশ্ন উঠেছে, সংঘর্ষে লিপ্ত হেলমেটধারী কাউকে শনাক্ত করতে না পারলেও ঘটনার সূচনায় মিথ্যা তথ্য প্রচারকারী ছাত্রলীগের তিনজনকে এবং কয়েকজন ‘সহিংস হকার’কে চিহ্নিত বা শনাক্ত করার কথা জানানোর পরও শুধু বিএনপির একজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ কি বিশেষ কোনো বার্তা দিল? এতে পুলিশের দক্ষতা, নাকি পক্ষপাতের প্রমাণ স্পষ্ট হলো? ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ‘লাঠিয়াল’দের ব্যাপারে উদাসীন থেকে নেপথ্যের ‘উসকানিদাতা’ বা কুশীলবদের ব্যাপারে অতি উৎসাহ দেখালে মানুষ প্রশংসা না করে সমালোচনা করবে। হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় অথবা ‘লন্ডনে থাকা একজন’কে টার্গেট করা যতটা সহজ, প্রকৃত দোষীকে শনাক্ত করে আইনের হাতে সোপর্দ করা তত সহজ নয়। কঠিন পথে হাঁটার অভ্যাস ত্যাগ না করলেই ভালো হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব আলোচনা-সমালোচনা হয়, তার সব না হলেও কিছু কিছু বিবেচনায় নেওয়া হলে খারাপ হবে না। ওসব থেকেও বেরিয়ে আসতে পারে অনুসন্ধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্লু বা উপাদান।
বিভুরঞ্জন সরকার, সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা