ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ খেপে গেলে তাঁকে বাগে আনা কঠিন ছিল। মাইহারে একবার বসেছে আসর। সরোদ বাজাবেন আলাউদ্দিন খাঁ। মহারাজা ছাড়াও তাঁর পারিষদেরা আছেন। অভ্যাগত অতিথিরাও এসে গেছেন। কাশ্মীরি গালিচায় বসেছেন আলাউদ্দিন খাঁ। মহারাজাদের মতো মাথায় পাগড়ি। পাশে নামজাদা তবলচি খলিফা আবিদ হুসেন খাঁ।
আলাপের পর ঢিমেতালে গৎ ধরলেন আলাউদ্দিন খাঁ। তবলচি তবলায় ঠেকা তুললেন। চোখ বন্ধ করে বাজাচ্ছেন আলাউদ্দিন খাঁ। সেটাই তাঁর অভ্যাস। কিন্তু একটু পরেই তিনি বুঝতে পারলেন, তবলচি অকারণেই লয় দ্রুত করে দিচ্ছেন। সরোদে তিনি লয় টেনে ধরতে চান, কিন্তু তবলচি তাঁর লয় বাড়িয়েই যেতে থাকেন। এবার চোখ খুললেন আলাউদ্দিন খাঁ। চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে আছে। কোনো কথা বললেন না। বোঝা গেল, মেজাজ আর তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। নিঃশব্দে পাগড়িটা মাথা থেকে খুলে রাখলেন। আসরের চারদিকে তাকালেন।
তারপর আবার চোখ বন্ধ করে জলদ গৎ ধরলেন। তারপর চলল সরোদ আর তবলার মধ্যে যুদ্ধ। কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না আলাউদ্দিন খাঁ। চোখ বন্ধ করে বাজিয়ে যেতে থাকলেন। সরোদের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে জেগে উঠল প্রাণ, তবলচি সংগত দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। মহারাজা তবলচির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। দেখলেন তাঁর মুখের কষ বেয়ে ফেনা বের হচ্ছে! তবলার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, আঙুল ফেটে বের হওয়া রক্তে তবলার চামড়া লাল হয়ে গেছে। তবলচির চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
একটু পর তবলা আর বায়ার ফাঁকে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন তিনি। তবলা থেমে যেতেই সংবিৎ ফিরে পেলেন আলাউদ্দিন খাঁ। বাজাতে বাজাতেই দেখলেন, মহারাজা করজোড়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বাজনা শেষ করার আকুতি তাঁর চোখে-মুখে।
বাজনা থামল। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তবলচিকে টেনে তুলে বললেন, ‘বাপুজি, জিন্দেগিমে আওর অ্যায়সা মাৎ কিজিয়ে।’
সূত্র: মোবারক হোসেন খান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর পত্রাবলি, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮