হোম > ছাপা সংস্করণ

আধুনিক প্রযুক্তির পোলট্রি খামার

শাইখ সিরাজ

একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পর কৃষক, ক্ষুদ্র খামারিরা ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশ গড়ার কাজে। দিনে দিনে আসে কৃষিতে বৈচিত্র্যের আহ্বান। সেজে উঠতে থাকে কৃষি। এক দিকে খাদ্যনিরাপত্তা, আরেক দিকে কর্মসংস্থান। দিনে দিনে প্রান্তিক কৃষক থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত হতে থাকে কৃষিতে, নানান উৎপাদনমুখী খামারে। শুরু হয় বৈচিত্র্যময় ফল-ফসলের চাষ, মাছের চাষ, মুরগি পালনসহ নানা রকম কৃষিজ কর্মকাণ্ড।

পুরোনো দিনের সব মানুষেরই নিশ্চয় মনে আছে, গ্রামের বাড়ির একটি পলোর নিচে একটি মুরগি আর তার কয়েকটি বাচ্চা। এই ছিল মুরগি পালনের চিরাচরিত দৃশ্য। সেখান থেকেই আসে ঘরে ঘরে খাঁচায় মুরগি পালনের আহ্বান। পাল্টে যেতে থাকে চিত্র। একে একে হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হয় পোলট্রি খামারে। লাভ-লোকসানের ভেলায় দুলতে দুলতে আজ পোলট্রিশিল্প বিশাল এক খাত। এ খাতে বিনিয়োগ পৌঁছে গেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার। আর এই শিল্পের খামারির সংখ্যা পৌঁছে গেছে প্রায় ৩ লাখে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বহু সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে পোলট্রিশিল্প কোথায় পৌঁছেছে, তার একটা উদাহরণ দিতেই আজকের এ লেখা।

গত জানুয়ারির শেষ দিকে গিয়েছিলাম গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার কেন্দুয়া গ্রামের ডায়মন্ড এগ লিমিটেড নামের এক প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাইসার আহমেদ আমার পূর্বপরিচিত। এই পরিচয়ও কর্মসূত্রে। গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকে এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে আধুনিক পোলট্রি খামার গড়ে উঠতে থাকে। তখন বড় আকারে প্রথম ওমেগা পোলট্রি নামে যে আধুনিক পোলট্রি খামার গড়ে তোলা হয় ঢাকার বেরাইদে, সেটিও ছিল কাইসার আহমেদ ও তাঁর ভাই আলিফ খানের। আমি সেই খামারের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। সেই সূত্রে কাইসার আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয়।

যা হোক, খামারে পৌঁছে দেখি বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয়। চীন-জাপান কিংবা ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে যেমনটি দেখেছি, ঠিক সে রকম বিশাল এক লেয়ার খামার। আগামীর খাদ্যনিরাপত্তা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভরতা ও জৈবনিরাপত্তার বিষয়গুলোকে সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। শুধু অর্থ বিনিয়োগ নয়, তিনি বিনিয়োগ করেছেন মেধা, স্বপ্ন ও সাহস। পোলট্রিশিল্পের জন্য সারা পৃথিবীর আধুনিক ব্যবস্থাপনা তিনি জেনে-বুঝে এসে স্থাপন করেছেন তাঁর খামার।

বিশাল খামারের এক প্রান্ত থেকে দেখা শুরু করে কথা বলছিলাম কাইসার আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, জৈবনিরাপত্তার জন্য ‘ডেনসিটি অব ফার্ম’ নয়, ‘ডেনসিটি অব বার্ডস’ অনুসরণ করা জরুরি। তিনি সেটাই অনুসরণ করছেন। বিশাল খামারটিতে লেয়ার মুরগির জন্য রয়েছে বড় বড় ৯টি বহুতল ছাউনি। এর ৫টির প্রতিটিতে রয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার মুরগি, মোট ৯ লাখ; বড় ৪টি ছাউনিতে রয়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৪০০ করে মুরগি, অর্থাৎ ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৬০০। সব মিলিয়ে ডিম দেওয়া মুরগি রয়েছে ২২ লাখ ৫৩ হাজার ৬০০। মোট উৎপাদনের ৮৫ ভাগ হিসাবে ধরা হয়। এই বিবেচনায় প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে ১৯ লাখের মতো।

বিশাল এই খামারে রয়েছে তিনটি পুলেট হাউস। একেকটি হাউসে রয়েছে ৬০ হাজার বার্ড। সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার। পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। কোথাও হাতের স্পর্শ নেই। মুরগির খাদ্য দেওয়া থেকে শুরু করে ডিম সংগ্রহ পর্যন্ত—সবখানেই যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা। দৃশ্যত একটি ডিম উৎপাদনের বহুতল কারখানা। অন্য যেকোনো শিল্পপণ্যের মতোই সেখানকার উৎপাদন কার্যক্রম।

কাইসার আহমেদ বলছিলেন, বাইরের উন্নত দেশগুলোতে দেখবেন খামারগুলোর উৎপাদনব্যবস্থা এবং বাজারের চাহিদা একটা সমান্তরাল রেখায় রাখা হয়। আমিও তা-ই করেছি। কাপাসিয়া উপজেলায় মোট ডিমের চাহিদার ভিত্তিতেই আমার খামারের উৎপাদন চলছে।

বিশাল খামার পুরোটা একবেলা ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু খামারের উৎপাদনব্যবস্থা থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায়। উৎপাদিত ডিম উৎপাদন ইউনিট থেকে চলে যাচ্ছে বাজারজাতকরণ ইউনিটে। কনভেয়ার বেল্টে অক্ষত অবস্থায় ডিম চলে যাচ্ছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শুধু ডিম বাজারে পাঠানোর আগে কনভেয়ার বেল্ট থেকে ডিম সংগ্রহ করে ক্যারেটে পূর্ণ করার কাজটির সময় কর্মীদের হাতের স্পর্শের প্রয়োজন পড়ে। পুরো ব্যবস্থাই কম্পিউটারাইজড এবং ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ডিম সংগ্রহের বিষয়টি বেশ মনোমুগ্ধকর। সারি সারি সাজানো ডিমের ট্রে দেখে মন ভরে যায়।

কাইসার আহমেদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আপনাদের আগের প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ওমেগা পোলট্রি। এটার নাম দিয়েছেন “ডায়মন্ড এগ”, কেন?’

কাইসার জবাবে বললেন, ‘ডায়মন্ডকে প্রকৃতির সবচেয়ে মূল্যবান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডিমে এমন পুষ্টি উপাদান আছে যেটি সুস্বাস্থ্যের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। তাই অনেক ভেবেচিন্তেই এমন নামকরণ করা হয়েছে। আর একটা বিষয়, আমরা খুব অর্গানিকভাবেই এই ডিম উৎপাদন করি। একটি শতভাগ সুস্থ মুরগির ডিমে যে পুষ্টি উপাদান থাকে, তা অন্য কোথাও এত সহজে পাওয়া কঠিন।’

জৈবনিরাপত্তার স্বার্থেই খামারে কর্মরত কর্মীদের জন্য ২৪ ঘণ্টার আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। জানা গেল, কর্মীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও পুষ্টিগত দিকে বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে কোম্পানির। শুধু একটি পোলট্রি খামার নয়, একটি বড় শিল্পকারখানার সামগ্রিক উৎপাদনকাঠামো। এই বিশাল কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে জৈব সার উৎপাদনের বিশাল কর্মযজ্ঞ। রয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের অন্যান্য আয়োজনও। প্রতিদিন প্রায় ১৬০-১৭০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয় খামারটিতে। প্রতিদিন ৮০ টন বর্জ্য থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে ৪০ মেট্রিক টন জৈব সার। আবার ৮০ টন বর্জ্য ব্যবহার করা হয় বায়োগ্যাস উৎপাদনে। উৎপাদিত বায়োগ্যাস খামারের চাহিদা মিটিয়েও গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবারকেও দেওয়া হয়েছে।

এই বিশাল শিল্পের উদ্যোক্তা কাইসার আহমেদ; একজন সাহসী ও সৃজনশীল শিল্প উদ্যোক্তা বটে। তাঁর স্বপ্নটি শুধু আজকের দিনের নয়, আগামীর খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তাকে সামনে রেখে শিল্প পরিকল্পনা করেছেন তিনি। খামারে ৩০ লাখ মুরগির খাবারও উৎপাদন করা হয় এই খামারেই। বাইরের খাবারের গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। মুরগির খাবার তৈরির প্রক্রিয়াটিও বিশাল। প্রতিদিন ৪০০ মেট্রিক টন মুরগির খাবার তৈরি করেন তাঁরা।

ঊর্ধ্বমুখী কৃষি উৎপাদন সম্প্রসারণের যুগে পোলট্রিশিল্পের এই ক্ষেত্রটিকে কাইসার আহমেদ উপস্থাপন করছেন সমন্বিত খামারের ক্ষেত্রে একটি মডেল হিসেবে। দিনদিন প্রসারিত হচ্ছে খামারের আকার ও আয়তন। নিয়মিত প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ঘটছে। গড়ে উঠছে নতুন আরেকটি ইউনিট। অল্পদিনের মধ্যে সেখানেও শুরু হয়ে যাবে দৈনিক ৩ লাখ ১০ হাজার ডিম উৎপাদন। আরও আশার কথা হলো, এই উদ্যোক্তার স্বপ্ন এখানেই শেষ নয়। এই পোলট্রি খাত নিয়েই আরও বড় স্বপ্ন রচনার পথে আছেন তিনি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ আজ এক স্বপ্ন-সম্ভাবনার অমিত ক্ষেত্র। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক থেকে শুরু করে একেকজন সাহসী খামার উদ্যোক্তা খাদ্যনিরাপত্তার পেছনে রেখে চলেছেন নিরন্তর ভূমিকা। ঠিক এই জায়গাগুলোতে দাঁড়িয়েই এক অন্য বাংলাদেশ দেখতে পাই। কাইসার আহমেদের মতো উদ্যোক্তা শুধু প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য যে স্বপ্ন রচনা করেছেন, তা এক উজ্জ্বল দিগন্ত খুলে দেয়। আমি বিশ্বাস করি, ব্যক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি পোলট্রি খাতে শিল্পায়নের যে দৃষ্টান্ত গড়েছেন, তা অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তাদের জন্যও অনুসরণীয়।

শাইখ সিরাজ, কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব; পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ