এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছি। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরে বাঙালি জাতি উন্নয়ন যাত্রাপথে সাফল্য অর্জনের কঠোর সংগ্রামে অবিচল জাতি হিসেবে বিশ্বে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটাগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ’ ক্যাটাগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।
জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন মোটা ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ধান উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন, ২০২০ সালে তা সাড়ে তিন গুণের বেশি বেড়ে ৩ কোটি ৮২ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ টন। ৭০ লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১ কোটি ২ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারী উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। গরুর মাংস ও দুধ উৎপাদনে দেশে এখনো ঘাটতি রয়ে গেলেও মাংস উৎপাদনে কয়েক বছরের মধ্যেই স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা যাবে বলে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। ঈদুল আজহার সময় অতীতে চোরাচালানে আসা ভারতীয় গরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এখন তার প্রয়োজন হয় না, বরং মাঝে মাঝে কোরবানির গরু উদ্বৃত্ত থাকছে। ছাগল উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও কাঁঠালের মতো কয়েকটি প্রধান ফল উৎপাদনেও এখন বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, যদিও বিদেশ থেকে নানা রকম বিদেশি ফল আমদানি ক্রমেই বাড়ছে। আমরা প্রতিবছর ৫৫-৬০ লাখ টন গমও আমদানি করি। তবু এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে একটি কৃষিবিপ্লব চলমান। ১৯৭০ সালে এ দেশে প্রায় ৩৫ লাখ টন ধান-চালের ঘাটতি ছিল, অথচ গত বছর এ দেশে ৩ কোটি ৮২ লাখ টন ধান উৎপাদিত হওয়ায় ১৭ কোটির বেশি মানুষের খাদ্যশস্য জোগান দিয়েও এখন প্রায় প্রতিবছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। খাদ্যসাহায্য এখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ-অনুদানের ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কৃষি খাতের সমৃদ্ধি বাংলাদেশের বৈশ্বিক ইমেজ বদলে ফেলার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে।
এটা অনস্বীকার্য যে দেশের কৃষিব্যবস্থা স্বাধীনতা-উত্তর ৫০ বছরে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিকীকরণ, প্রান্তিকীকরণ এবং নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছে। কৃষি উপকরণের বাজারে এবং কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণে পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া ক্রমেই অনুপ্রবেশ করছে। অন্যদিকে, ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহকারী গ্রামীণ ব্যাংক ও এনজিওগুলোর দ্রুত বিস্তারের কারণে কৃষকেরা মহাজনি ঋণের শোষণ প্রক্রিয়া থেকে অনেকখানি মুক্তি পেলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘এনজিও ঋণের ফাঁদে’ আটকে যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ের কৃষকেরা এখনো তাঁদের ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, বাম্পার ফলন হলে ফসলের দামে ধস নামার পুরোনো সমস্যার ভালো সমাধান এখনো আমরা পাইনি। এই নেতিবাচক প্রক্রিয়াগুলোর বিপরীতে কৃষি খাতে অনেকগুলো ইতিবাচক পরিবর্তনও সূচিত হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, সেচ ব্যবস্থার আওতায় আসায় দেশের অধিকাংশ জমিতে বোরো চাষের সম্প্রসারণ, কৃষি খাতে যথাযথ ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণ পদ্ধতির সহজীকরণ, ফসলের বহুধাকরণ, কৃষির লাগসই যান্ত্রিকীকরণ, উচ্চফলনশীল ফসল, তরিতরকারি, মাছ, হাঁস-মুরগি ও ফলমূল চাষের ব্যাপক প্রচলন, আধুনিক রাসায়নিক সার, বীজ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ফলে নেতিবাচক প্রবণতাগুলো ছাপিয়ে উৎপাদনশীলতার উল্লম্ফন দেশে একটি কৃষিবিপ্লবের সূচনা করেছে। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে দেশের জিডিপির মাত্র ১৪ শতাংশ কৃষি খাত থেকে এলেও কৃষিতে এখনো দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ কর্মরত রয়েছেন।
উপরন্তু বাংলাদেশ থেকে যে ১ কোটি ৩০ লাখ অভিবাসী বিশ্বের নানা দেশে কর্মরত রয়েছেন, তাঁরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রতিবছর যে ১৭-১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক নানাবিধ চ্যানেলে যে আরও ৮-১০ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তা অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভিবাসীদের ৯০ শতাংশ গ্রামীণ জনপদের অভিবাসী, তাই এই বিশাল রেমিট্যান্স প্রবাহের সুফলের সিংহভাগও গ্রামের অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করে চলেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দারিদ্র্য দ্রুত নিরসনের বড় কারণ এই রেমিট্যান্স প্রবাহ। রেমিট্যান্সের সুফলভোগী পরিবারগুলোর বর্ধিত ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড়সড় সমৃদ্ধির জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাড়িঘর পাকা হচ্ছে, অন্য ধরনের বসতঘরেরও মান বেড়েছে, ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, পরিবারের সদস্যদের আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সামর্থ্য বাড়ছে, শিশুমৃত্যুর হার কমছে, স্যানিটারি পায়খানার প্রচলন বাড়ছে, ঘরে ঘরে টিউবওয়েল বসে গেছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে এসেছে, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং গ্রামের রাস্তাঘাটেও আধুনিক পরিবহন চালু হয়ে গেছে। এর ফলে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ৪-৫ কোটি মানুষ এখন নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত অবস্থানে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কৃষি খাতের সাফল্যের পেছনেও বাংলাদেশি অভিবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। কৃষিতে উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির প্রসার, সেচব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, গ্রামীণ যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, আধুনিক স্বাস্থ্যসুবিধা গ্রহণের পারঙ্গমতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বিপুল অবদান রাখছে।
ওপরে অর্থনীতির সামষ্টিক অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ জনসমাজের যে পরিবর্তনগুলো বর্ণনা করা হলো, সেগুলোর পাশাপাশি এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা শক্তিশালী হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩৩, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে শূন্য দশমিক ৪৮৩-এ পৌঁছে গেছে। এই ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের প্রত্যক্ষ শিকার গ্রামীণ জনগণ। সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো শহরে-নগরে এবং প্রধানত রাজধানীতে বসবাস করা এবং সম্ভব হলে ধন-সম্পদ নিয়ে উন্নত বিশ্বে চলে যাওয়া। এ দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও দেদার বিদেশে পুঁজি পাচার করে বিদেশে অভিবাসী হয়ে যাচ্ছে। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছেই দেশের খেলাপি ব্যাংকঋণের ৮০ শতাংশের বেশি আটকে রয়েছে এবং এই ব্যাংকঋণ লুটেরা ঋণের সিংহভাগ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ নিকৃষ্ট নজির হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এখনো এ দেশের সাধারণ জনগণের মতো গ্রামীণ জনগণেরও জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা, যাতনা ও হয়রানি ঘটিয়ে চলেছে সরকারের সব স্তরের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করলেও গত তিন বছরে এই অঙ্গীকার পূরণকে সত্যিকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। গ্রামীণ জনগণের জীবনের আরেকটি বিভীষিকার নাম শাসক দলের নেতা-কর্মীদের মাস্তানি ও গুন্ডামি। দেশ থেকে নির্বাচনী রাজনীতি নির্বাসিত হয়ে গেছে। দেশে অদূর ভবিষ্যতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে কি না, সে সম্পর্কে জনমনে সর্বনাশা আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি গ্রামের ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে এবার যে সন্ত্রাস, খুনোখুনি, মাস্তানি ও জালিয়াতি পরিদৃষ্ট হলো, তাতে প্রশ্ন উঠছে, অর্থনৈতিক অভাব-অনটন বেশ খানিকটা কমে গেলেও বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ আসলে কি শান্তিতে আছে?
ড. মইনুল ইসলাম: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়