পড়াশোনা করতে চেয়েছিল মেয়েটি। শ্বশুরবাড়ি থেকে ছিল আপত্তি। পাঁচ মাসের শিশু আছে ঘরে। তাই পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে—এই ছিল স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকে আদেশ। মেয়েটি সংসার এবং পড়াশোনা একসঙ্গে করতে চেয়েছিল। সেটা মেনে নেওয়া হবে কেন? ফলে স্বামী তালাকের চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন। নরসিংদীর রায়পুরায় ঘটেছে এ ঘটনা।
বিষয়টিকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে ছেড়ে দেওয়া যেত। পারিবারিক সিদ্ধান্তে বাইরের মানুষেরা নাক গলালে তা দৃষ্টিশোভন হয় না। কিন্তু কিছু ব্যাপার থাকে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ব্যাপার মনে হলেও তার প্রভাব পড়ে সামাজিক জীবনে। সমাজের মানুষ তাদের ভাবনা-চিন্তাকে কোন দিকে প্রসারিত করছে, সেটাও তা থেকে জানা যায়।
মানুষ কূপমণ্ডূক হয়ে যাচ্ছে, নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে পরিবর্তিত করে নিতে পারছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সন্তানের দেখভাল যে শুধু নারীর বিষয় নয়, সবার ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে সন্তান, সেটা না বুঝলেই বিপদ বাড়ে।
জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদেশ সফরে গেলে একটা কাজ করতেন। তিনি সে দেশের দুটি জায়গায় গিয়ে হাঁড়ির খবর খুঁজতেন। একটি হলো কাঁচাবাজার, অন্যটি বইয়ের দোকান। এই দুটো জায়গায় গেলে সেই দেশের মানুষের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির দেখা মিলত। যেমন ইস্তাম্বুলের বইয়ের দোকানে গিয়ে অধ্যাপক রাজ্জাক দেখলেন, ৩০ শতাংশ বই কমিউনিজমের ওপরে লেখা, ৩০ শতাংশ বই ধর্ম বিষয়ে লেখা। তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, এই দেশে হানাহানি থামানো কঠিন।
পড়াশোনা এবং নারী—এ ব্যাপারে আমাদের সমাজ মূলত রক্ষণশীল। নির্দ্বিধায় বলা যায়, রক্ষণশীল ভাবনা শুধু পুরুষের মস্তিষ্কপ্রসূত এবং পুরুষের মধ্যেই বিরাজ করে, তা নয়। পুরুষেরা সে ভাবনা যুগ যুগ ধরে নারীদের মধ্যেও আরোপ করেছে। যার ফলে নারীরা শিক্ষার আলো পাবে, সংসারে অর্থনীতির হাল ধরবে—এ রকম ভাবনা হালে পানি পায়নি। আমাদের বৃহত্তর সমাজ এখনো তা পুরোপুরি মেনে নেয়নি। নানা ধরনের কুসংস্কার আমাদের স্থবির করে রাখতে চাইছে।
সমাজের এই স্থবিরতার একটা বড় কারণ হচ্ছে, নারীকে তার যোগ্য আসন বঞ্চিত করা। আমাদের দেশের পুরুষেরা তাঁদের স্বাধীনচেতা মনোভাব প্রকাশ করতে গিয়ে হয়তো নারীমুক্তির সপক্ষে কথা বলেন। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, তাঁরা সব নারীর মুক্তি কামনা করেন—নিজের মা, স্ত্রী এবং কন্যা ছাড়া। এই ট্র্যাডিশন চলতে থাকলে নারীরা এই দুর্ভাগ্যজনক সামাজিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না।
বেগম রোকেয়া বাঙালি মুসলমান নারীদের সামাজিক অন্ধকার থেকে বের করে আনতে চেয়েছিলেন। কিছুটা পেরেছেন। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করলে মনে হয়, এখনো আমরা পশ্চাৎপদ হয়েই রয়েছি। রায়পুরার ঘটনাটি যে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সে কথা ভেবে আরও খারাপ লাগছে। মানুষ এসব ব্যাপারে রক্ষণশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এ রকম ঘটনায় সমাজের প্রকৃত চিত্রটি পাওয়া যায়। এটা অনেকটা উল্টো দিকে হাঁটার মতো। আলো থেকে অন্ধকারের দিকে।