আরবি ভাষায় ফি-মাফির বঙ্গানুবাদ; আছে এবং নেই। অথচ ইরাকে ‘আছে’কে ‘আকু’ এবং ‘নাই’কে ‘মাকু’ বলে। আরবিভাষী আরব জগতে ভাষার ভিন্নতা সামান্য হলেও সব আরব দেশেই রয়েছে। তবে একটি বিষয়ে বোধকরি ভিন্নতা নেই, সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রপ্রধানদের একনায়কত্বের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। সর্বত্রই একনায়কতন্ত্রের জয়যাত্রা। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। জনগণের ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নেই রাষ্ট্র পরিচালনায়। ক্ষমতার পালাবদলও জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে ঘটে, উত্তরাধিকারী সূত্রে। গণতন্ত্রের সব দুয়ার সেখানে রুদ্ধ। মার্কিনরা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মাছের মায়ের মায়াকান্না করলেও, মার্কিন তাঁবেদার আরব দেশগুলোর স্বেচ্ছাচারী অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমে প্রত্যক্ষ অবদান রেখে চলেছে। তার প্রধানতম কারণ প্রায় সব আরব দেশই মূলত মার্কিনদের আজ্ঞাবহ সেবাদাসে পরিণত এবং মার্কিন স্বার্থরক্ষায় অনুগত। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক তেল। এই তেলের নিয়ন্ত্রণও মার্কিনদের হাতে। তাই মার্কিনরা আরব দেশগুলোর রাজা-বাদশাহ-আমির-শেখ-একনায়কদের টিকিয়ে রেখেছে নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। যারা বশ্যতা মানেনি, তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অজুহাতের খড়্গ। যেমন ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি। মার্কিনদের আগ্রাসনে অগণিত মানুষ হত্যা-ধ্বংসপ্রাপ্ত ইরাক আর আমার দেখা অতীতের ইরাক আজ আমার কাছে স্বপ্নতুল্য। চোখ বন্ধ করে যে নয়নাভিরাম ইরাকের ছবি চোখে ভেসে ওঠে, সেই ইরাককে দখলদার মার্কিনরা অক্ষত রাখেনি। ইরাক মার্কিন তাণ্ডবে ক্ষতবিক্ষত এক ভয়ংকর জনপদ। মার্কিন নিষ্ঠুরতা নাৎসিদেরও হার মানিয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞের দগদগে ক্ষত নিয়ে কোনোভাবে টিকে থাকা দেশ এখন ইরাক।
১৯৮১ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আমি ইরাকের কিরকুক, বাগদাদ, বসরা, আকাসাত, আল-কাইম, আবেইদি, রামাদি, ফালুজা প্রভৃতি জায়গায় কর্মসূত্রে থেকেছি। মাঝেমধ্যে ঢাকার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লেখা পাঠাতাম, ছাপা হতো। ১৯৮৪ সালে ছুটিতে ঢাকায় এলে বিচিত্রা অফিসে নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে আলাপে তিনি আমাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক লেখার তাগিদ দেন। ইরাকে ফিরে কিরকুকে আমার দেখা ইরাকি নিরাপত্তারক্ষীদের কুর্দি গেরিলা-নির্মূল অভিযানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে একটি লেখা পাঠাই ছদ্মনামে (ম. ইসলাম), সেটা ছাপা হয়েছিল। ছদ্মনাম থাকায় ওই লেখাটির জন্য আমাকে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। অথচ লেখাটি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং ইরাক সরকারের বিরুদ্ধে বিপজ্জনক।
পরে ঢাকার শিশু একাডেমির ‘দুরন্ত’ ভাস্কর্য ভাঙা, গুলিস্তানে রাতের আঁধারে ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। অথচ ইরাকজুড়ে দেখেছি আক্-কাদিয়, সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, মেসোপটেমিয়া সভ্যতার স্মারক অগণিত ভাস্কর্য সারা ইরাকের প্রতিটি শহরের সড়কদ্বীপে স্থাপন করা রয়েছে। নিজেদের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন তুলে ধরার সে এক অনন্য নজির। মর্জিনা-আলিবাবা উপাখ্যানের ভাস্কর্য দেখেছি বাগদাদের প্রাণকেন্দ্রে। ৪০টি মটকায় মর্জিনা কর্তৃক ফুটন্ত তেল ঢেলে ৪০ ডাকাত হত্যার দৃশ্য পাথরে খোদাই করা অপূর্ব ভাস্কর্য। পানির ফোয়ারা, তেলের স্থলে পানি ঢালছে মর্জিনা। অত্যাধুনিক আলোকসম্পাতের মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দিত ভাস্কর্যগুলো অসাধারণ কেবল নয়, অনন্যও। আরবি ভাষায় আলিবাবা কিন্তু কোনো ব্যক্তির নাম নয়। আলিবাবার বঙ্গানুবাদ চোর। উপাখ্যানটি চোরের কাহিনি হিসেবেই খ্যাত। ডাকাতদের গুহা থেকে চুরি করেছিল বলেই সে চোর।
এ ছাড়া বাগদাদসহ ইরাকের শহরগুলোতে ক্যাসিনো, নাইটক্লাব, পতিতালয়সহ পশ্চিমা স্থূল বিনোদনের সব উপকরণ দেখেছি। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, তুর্কি, লেবানন, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মেয়েরা নাইটক্লাবে বিয়ার পানের বিনিময়ে সঙ্গ দিত খদ্দেরদের। তারা দেহ-ব্যবসায়ও যুক্ত ছিল। আমাদের দেশের পান-বিড়ির দোকানের মতো ইরাকের যত্রতত্র মদ-বিয়ারের দোকানের ছড়াছড়ি। শবেবরাত ধর্মীয়ভাবে আমাদের উপমহাদেশে পালিত হলেও, ইরাকে ওই দিন কোনো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা দেখিনি। স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলে শবেবরাত সম্পর্কে তারা অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। ওই দিনের কোনো ধর্মীয় আচার-আনুষ্ঠানিকতা ইরাকে পালিত হতেও দেখিনি। ওই দিন বাগদাদ ঘুরে নাইটক্লাব, বার, ক্যাসিনো—সবই খোলা দেখেছি। কোরবানির ঈদের দিন বাগদাদ শহরের কোথাও পশু কোরবানি না দেখে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করায় তারা বলেছিল, হ্যাঁ, কোরবানি আমরা দিই, তবে হজের সময়। প্রতিবছর নয়। কেননা, কোরবানি অনিবার্যরূপে হজের আনুষ্ঠানিকতার অংশ। প্রতিবছর গৃহে কোরবানি দেওয়ার কোনো ধর্মীয় বিধিবিধান নেই। শুনে বিস্মিতই হয়েছিলাম।
যুদ্ধের কারণে পুরুষদের অনুপস্থিতিতে ইরাকি নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মদক্ষতা দেখে হতবাক হয়েছি। শিক্ষায়, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মে, কৃষি, শিল্পে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। ইরাকে নারীরা পূর্ণ অধিকার নিয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতেন বার্থ সোশ্যালিস্ট পার্টির শাসনামলে। তবে শুরুতেই বলেছি একনায়কতন্ত্রের কথা। ইরাকও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এক নেতা, এক দেশ, সাদ্দাম হোসেনেরই ছিল একচ্ছত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা। ইরাকের সামাজিক এসব বিষয় নিয়েই লিখেছিলাম ‘পাশাপাশি’ শিরোনামের লেখাটি, ১৯৮৫ সালের ১২ জুলাই সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল।
স্বনামে লেখার কারণে আমার জন্য তা বয়ে আনে এক ভয়ংকর তিক্ত অভিজ্ঞতা। যতটুকু জেনেছিলাম, ওই লেখাটিকে যুদ্ধাপরাধী এরশাদ সরকারের ধর্মমন্ত্রী ইনকিলাব পত্রিকার মাওলানা মান্নান আরবিতে অনুবাদ করে ঢাকার ইরাকি দূতাবাসে পৌঁছে দেন এবং আমার বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে আসেন। ঢাকার ইরাকি দূতাবাস আরবি অনুবাদটি বাগদাদে ইরাকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
বাগদাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাগদাদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে লেখাটি সম্পর্কে অভিযোগ ও আপত্তি জানায়। রাষ্ট্রদূত আমার প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে দূতাবাসে ডেকে বিষয়টি অবগত করেন। পরিচালকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো দশা। হুলুস্থুল ব্যাপার ঘটে যায়। আমি তখন রামাদি ও ফালুজা দুই জায়গায় কর্মরত। পালা করে দুই জায়গায় থাকছি। তিনি আমাকে জরুরিভাবে বাগদাদে তলব করে তীব্র ভর্ৎসনা করে লেখাটি যে আমি লিখিনি, তেমন স্বীকারোক্তি আদায়ের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। অভিযোগ এই যে স্বনামে লিখে নিজেকে ও সবাইকে বিপদে ফেললাম। ইরাকে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। লেখাটিতে সাদ্দামের বিরোধিতা ছিল না। কিন্তু যা লিখেছি তার একটি শব্দও মিথ্যা নয়। ইরাকি জনগণের প্রতি ভালোবাসার টানে আমি অনেক নেতিবাচক বিষয় লেখার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করিনি। আমাদের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পে দেখা ও কথা হয়। তিনি এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন আমাকে, মিথ্যা একটি বাক্যও না-থাকায় প্রচলিত আইনে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না। খুব বেশি হলে ইরাক থেকে বহিষ্কৃত হতে পারি। ওই একই দিন বাগদাদের আল-নাসের প্রকল্পে দুপুরের খাবারের পর বিদায়ের সময় আমার পিঠে হাত দিয়ে ‘বেশি-বেশি খান আর বেশি-বেশি লিখে যান’ বলে রসিকতাও করেছিলেন রাষ্ট্রদূত।
আমার জন্য ভয়ানক বিব্রতকর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছিল। চিঠি পেলাম ইরাকি উচ্চপদস্থ গোয়েন্দাদের সঙ্গে আল-কাইম রেসিডেন্স অফিসে সাক্ষাতের জন্য। নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণে তাদের মুখোমুখি হতেই উষ্ণ সম্ভাষণে আমাকে সোফায় নিয়ে বসাল। অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে হাস্য-রসিকতা করল কিছুক্ষণ। অল্পক্ষণ পরেই তাদের দম ফাটানো হাসি আর রসিকতা উবে গেল। তাদের হাসি মুখ কঠিন হয়ে গেল। আমাকে নানা প্রশ্নের জালে জড়ানোর অপচেষ্টা চালাল। আমি ইরান গিয়েছি কি না, ইরানের সঙ্গে আমার কোনো যোগসূত্র আছে কি না? লোভ দেখানো হয় তুরস্কে যাওয়ার সব খরচ তারা বহন করবে। আমি যেন তুরস্ক ঘুরে এসে তুরস্কের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে লিখি। আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো আমাকে খণ্ডন করার কোনো সুযোগই তারা দিল না।
বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে বিফল হলাম। তাদের অভিযোগ ছিল মুসলিম বিশ্বে ইরাকের ভাবমূর্তি বিনষ্টের অপচেষ্টার। দুটি মুসলিম দেশ (ইরাক ও ইরান) তখন যুদ্ধরত, এই যুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন তাদের পক্ষে। এ লেখায় নাকি তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টা তাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত ছিলাম, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর বা জবাব দেওয়ার সামান্য সুযোগ তারা আমাকে দেয়নি। বিদায়ের সময় বলেছিল, তোমাকে খুব শিগগির তোমার নিজ দেশে চলে যেতে হতে পারে।
ইরাকি গোয়েন্দারা তাদের কথা রেখেছিল। এর দিন পনেরো পরে আমার রেসিডেন্স পারমিট নবায়নের তাগিদপত্র পেলাম। ভিসা নবায়ন করতে গেলে আমাকে সবার থেকে আলাদা করে একটি কক্ষে নিয়ে কটি কাগজ স্বাক্ষরের জন্য এগিয়ে দেয়, যা আরবি ও ইংরেজিতে লেখা। তাতে লেখা ছিল, আমি আর কোনো দিন ইরাকে যেতে পারব না। ইরাকের দরজা আমার জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ। যদি কখনো ইরাক যাই, তাহলে আমাকে প্রচলিত আইনে শাস্তি পেতে হবে। অঙ্গীকারনামা এবং এই চুক্তি মোতাবেক আমাকে ইরাক থেকে বহিষ্কার করা হলো। আগামী ১০ দিন সময়সীমার মধ্যে আমাকে ইরাক ছাড়তে হবে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমার ইরাক বসবাসের পাট চুকে ছিল।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত