হোম > ছাপা সংস্করণ

শোষণের বেড়াজালে মানুষের প্রাণ

সঙ্গীতা ইমাম

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৫৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্লোগানটিই বর্তমান বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের আসল চিত্র বলে আমি মনে করি। আর সে কারণেই স্লোগানের প্রথম অংশটুকু লেখার শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করলাম। মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা আর সাম্যের জন্য উদীচী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করে আসছে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে উদীচী যেমন বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে উদীচী প্রতিবাদের মিছিলে হেঁটেছে আদর্শের মশাল হাতে। সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার চেতনার লড়াইকে গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে উদীচীর ৭১টি সাংগঠনিক জেলা সংসদ এবং জেলা সংসদের অধীনে ৩১৫টি শাখা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায়ও উদীচীর শাখা রয়েছে।

বিপ্লবী কথাশিল্পী সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তসহ একঝাঁক তরুণ ১৯৬৮ সালে উদীচী প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনের আদর্শ ধারণ, আর সংগ্রামের ইতিহাস পাঠ উদীচীর কর্মী হিসেবে আমাদের প্রতিদিনের কাজ। সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথচলায় মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে জীবনের গান গেয়ে দ্রোহের বীণায় উদীচী শুনিয়েছে অসুরবিনাশী সুর। আজ যখন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে উদীচীর ৫৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, তখন বিপুল চক্রবর্তীর লেখা উদীচীর গানেই যেন স্মরণ করতে হয় আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘তোমার স্বদেশ লুট হয়ে যায় প্রতিদিন প্রতিরাতে/ বিরুদ্ধতার চাবুক উঠাও হাতে...’। আজ যখন পুরো পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে ভয়াবহ যুদ্ধের ময়দানে, মানুষের জীবন জেরবার হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক নানা সংকটে; দেশের মিডিয়ায় ইউরোপজুড়ে জনগণের বিদ্রোহ, ইরানের আন্দোলন বা পাশ্চাত্যে সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার খবরগুলো পড়ি; টেলিভিশনের পর্দায় কেবল মূল্যস্ফীতি, নিত্যপণ্যের উচ্চ বাজারদর আর সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া জীবনের ছবি দেখি, তখন প্রশ্ন জাগে, এ সংকটময় বাস্তবতায় আমাদের সংস্কৃতি কোন দিকে যাবে? আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে আমাদের রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধান—সবাই আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে আগাম সতর্ক করছেন। বিশ্বজুড়ে একবিংশ শতাব্দীর উন্নত প্রযুক্তি ও স্থিতিশীল অর্থনীতির কত গালভরা গল্পই না শুনে এসেছি এত দিন। অথচ এখনো দুর্ভিক্ষ আর খাদ্যাভাবের শঙ্কা আমাদের পিছু ছাড়েনি।

ফলে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল অনিবার্যভাবেই আজ প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে বদলে যেতে বাধ্য। যুদ্ধদানব গোটা পৃথিবীকে এক ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে; কোনো একক দেশের পক্ষে সে প্রলয় রোধ করা সম্ভব নয়।

তাই সাংস্কৃতিক ঐক্য বা শোষণের বেড়াজাল ছিন্ন করার আন্দোলন কেবল দেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার আহ্বান জানায় উদীচী।

১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর উদীচী প্রতিষ্ঠিত হলেও, সত্যেন সেনের নেতৃত্বে এর পটভূমি তৈরি হতে থাকে আরও আগে থেকেই। ১৯৪৬ সালে মানবিক ও সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই সত্যেন সেন গঠন করেন কবিয়াল দল। এরপর দীর্ঘ প্রায় এক দশক কারাবরণসহ শাসনযন্ত্রের নানা নির্যাতনের শিকার হন তিনি। কিন্তু এই মহান বিপ্লবী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের আদর্শিক লড়াই থেমে থাকেনি। কৃষিপ্রধান বাংলার সামগ্রিক নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদ্বোধনের মূল শক্তিই হলেন বাংলার কৃষকেরা—এ সত্য তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন তখনই। ফলে শাসকদের নিপীড়ন আর নির্যাতনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কৃষকদের মাঝেই কাজ চালিয়ে গেছেন তাঁরা। তখনই সত্যেন সেন উপলব্ধি করেন সংস্কৃতি মানুষকে যতটা উদ্বুদ্ধ করতে পারে, ততটা পারে না রাজনৈতিক বক্তব্য। তাঁর এই উপলব্ধি একটি তাগিদ হিসেবে কাজ করে ঢাকা জেলা কৃষক সম্মেলনে।

ফলে শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেন এমন একটি সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা করেন সমাজবদলের ক্ষেত্রে, যার হাতিয়ার হবে সংস্কৃতি। গণসংগীতের সুরে মানুষের অধিকারের কথা, নাটকের সংলাপে মানবমুক্তির ইশতেহার, কবিতার শাণিত পঙ্‌ক্তিমালায় মনুষ্যত্বের অনির্বাণ দ্রোহ, সাহিত্যের পাণ্ডুলিপিতে সাম্যের শব্দ-বাক্য-শিল্পী সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তের এই চিন্তাধারারই ফসল আজকের বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

উদীচীর প্রতিষ্ঠা এমন একটি সময়ে, যখন বাংলার মানুষ দুর্বার প্রাণশক্তিতে শামিল হচ্ছে স্বাধীনতার সংগ্রামে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই আমাদের ইতিহাস প্রবেশ করে স্বাধিকারের স্বর্ণমন্দিরে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে একদিকে যেমন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের ব্যালট বিপ্লব, অন্যদিকে তেমনি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোর লাখ লাখ সহায়-সম্বলহীন মানুষের আর্তনাদ ধ্বনিত হয়। প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছরেই উদীচী তার সবটুকু সম্বল নিয়ে সাড়া দিয়েছে মানবিক ও দ্রোহের ডাকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে উদীচীর শিল্পীকর্মীরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অস্ত্র জমা রেখে ঢোল, করতাল, হারমোনিয়াম, তবলা, নাটকের পাণ্ডুলিপি হাতে দেশ গড়ার সংগ্রামে শামিল হয়েছেন। বাহাত্তরের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে প্রতিফলন ঘটেছিল, সে পথেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক সাম্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদীচী তার কাজ করে গেছে। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে ও কারা-অন্ধকারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর বাহাত্তরের সংবিধান থেকে ছিটকে পড়ে বাংলাদেশ। সব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে। সুবিধাবাদী চাটুকারেরা অবৈধ ক্ষমতার দাপটে রাষ্ট্রযন্ত্রকে তৈরি করে নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু শত নির্যাতনেও উদীচী তার লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে।

উদীচীর সুদীর্ঘ ইতিহাস নানা চড়াই-উৎরাই, বাধাবিপত্তি, আনন্দ-বেদনার ইতিহাস। ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর নির্মম হামলার শিকার হতে হয়েছে উদীচীকে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের খড়্গ নেমে এসেছে কখনো কখনো। কিন্তু উদীচীর পথচলা থেমে থাকেনি, থাকবেও না। আজ যে আর্থসামাজিক সংকটের মুখে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে তা মোকাবিলাতেও উদীচী তার সর্বস্ব নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে অতীতের মতোই। বিশ্বমানবতার মুক্তির লক্ষ্যে উদীচীর যুদ্ধবিরোধী যে সংগ্রাম, আজকের সংকটে তা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে।

লেখক: সঙ্গীতা ইমাম, সহসাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ