হোম > ছাপা সংস্করণ

বিদেশি শক্তির কাছে যাওয়া না-যাওয়া

মহিউদ্দিন খান মোহন

আমাদের বিক্রমপুরের একটি প্রবাদবাক্য, ‘কারে কমু কলই চোরা, নিজের মাথায় এক বোঝা’। এর মর্মার্থ হলো, একই দোষে দোষীরা একে অপরকে নিন্দা-সমালোচনা করা মানায় না, উপদেশ দেওয়া তো নয়ই। আমাদের সমাজজীবনের নানা স্তরে এই প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।

দেখা যায়, যে লোকটি একটি কাজের নিন্দা করছে, সে নিজেই ওই কাজে লিপ্ত, গোপনে বা প্রকাশ্যে। রাজনীতিতেও এর ব্যতিক্রম নেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি নিন্দা-সমালোচনার বাক্য গোলা নিক্ষেপ করতে বড়ই সিদ্ধহস্ত।

তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নানা রকম মুখরোচক কথাবার্তা বলে থাকে, যা জনসাধারণ বেশ উপভোগ করে। অবশ্য এটাকে আমি নেতিবাচক হিসেবে দেখি না। এই সমস্যা-সংকুল সময়ে আমাদের মুখের হাসি তো কর্পূরের মতো উবে গেছে প্রায়। সে সময় রাজনীতিকদের কোনো কোনো কথা যখন হাস্যরসের সৃষ্টি করে, তখন প্রাণ খুলে একটু হাসার সুযোগ পাওয়া কম কথা নয়।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল। একটি আরেকটির পরিপূরক। বলা যায় একটির বিকল্প আরেকটি। এই দুই বড় দলের সাংগঠনিক দুই দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি অতিসম্প্রতি এমন কথা বলেছেন যা সাধারণ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। কাকতালীয় কি না জানি না, তবে তাঁরা কথাগুলো বলেছেন একই দিনে, তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে একই দিনে। ১৯ জুনের আজকের পত্রিকায় তাঁদের বক্তব্য ছাপা হয়েছে পাশাপাশি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনে জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। বিদেশি দেশ আমাদের বন্ধু। তারা আমাদের নির্বাচনে জয়ী করতে পারবে না। তারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী হতে পারে। তারা আমাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে, এমন চিন্তা উদ্ভট।’

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশ কয়েকটি দেশের মন্তব্য ও আগ্রহ প্রকাশের পর সবার নজর এখন ভারতের দিকে—গণমাধ্যমের এমন খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি উপরিউক্ত মন্তব্য করেন। অন্যদিকে একই দিনে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমাদের বলে আমরা নাকি বিদেশিদের কাছে যাই। আমরা বিদেশিদের কাছে যাই না। মাঝে মাঝে বিদেশিরা আমাদের ডাকে। জানতে চায় যে দেশে কী হচ্ছে।’

(আজকের পত্রিকা, ১৯ জুন, ২০২৩) দুই দলের সেক্রেটারি জেনারেলের এমন বক্তব্যে আমরা খুশি হতে পারতাম, যদি বাংলাদেশের অতীত এবং বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের বক্তব্য সর্বাংশে সত্য হতো; বরং উল্টো হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা, ফি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের আগে আমাদের রাজনীতিতে সৃষ্ট জটিলতার সুযোগে যে বিদেশিরা নাক গলানোর মওকা পায় তা অস্বীকার করবে কে? ১৯৯৬ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে এসেছে। সবারই মনে থাকার কথা, ১৯৯৬-এর নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর যুগপৎ আন্দোলনে দেশের রাজনীতিতে যখন টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তখন বিদেশি শক্তির তৎপরতা আমরা দেখেছি।

সে সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে সালিস করতে এসেছিলেন কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ দূত স্যার স্টিফেন নিনিয়ানসহ নানাজন। তাঁরা সমস্যা সমাধানে কোনো অবদান রাখতে পারেননি। সমস্যার নিরসন হয়েছিল আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই। ক্ষমতাসীন বিএনপি বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেওয়ায় জটিলতার অবসান ঘটে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ (জুন) ও ২০০১ সালের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও গোল বাধে ২০০৭ সালে এসে। ক্ষমতাসীন বিএনপির কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্তকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতিতে তোলে সাইক্লোন। তখনো বিদেশিদের তৎপরতা ছিল একবারে প্রকাশ্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটেনের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর কর্মকাণ্ড কূটনৈতিক শৃঙ্খলাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। নানা ঘটনায় এমন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল যে অনেকে তা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় দেখছিলেন না।

তারপরের ইতিহাস সবারই জানা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ, ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল, বিএনপি কর্তৃক ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এবং আওয়ামী লীগের দাপটে দলটির প্রার্থীদের মাঠ থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা সবার স্মৃতিতেই জ্বলজ্বল করছে। যে ঘটনাগুলোর কথা উল্লেখ করা হলো, সেগুলো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থচিন্তা থেকেই উদ্ভূত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আসলে ‘মৌখিক গণতন্ত্রী’; অর্থাৎ তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মুখে গণতন্ত্রের খই ফোটান। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে একবার বসতে পারলে গণতন্ত্রের কথা আর মনে থাকে না। তখন কীভাবে ক্ষমতা স্থায়ী করা যায়, সে চেষ্টায় রত হয়। আর এ থেকেই সব বিপত্তির উৎপত্তি। সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো, একপর্যায়ে এসে রাজনৈতিক দলগুলো একদিকে নিজেদের শক্তির ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলে, অন্যদিকে জনগণের ওপরও তাদের আস্থা কমে যায়। এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য তখন তারা দ্বারস্থ হয় বিদেশি শক্তির। ধরনা দেয় তাদের দরবারে।

ওবায়দুল কাদের কিংবা মির্জা আলমগীর, যতই বলুন তাঁরা বিদেশিদের মুখাপেক্ষী নন, বাস্তবতা সে কথা সমর্থন করে না। কেননা, অতীতে আমরা কোনো কোনো রাজনৈতিক দলকে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে বিদেশি শক্তির কাছে রীতিমতো নালিশ করতে দেখেছি। এই নালিশ করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই ধোয়া তুলসী পাতা নয়। সবাই একই দোষে দুষ্ট। কেউ রাজনৈতিক কূটনীতিতে সফল, কেউ ব্যর্থ। যারা সফল তাদের পক্ষে কোনো কোনো দেশের বড় বড় কর্তারা এসে প্রকাশ্যে ভূমিকা রাখেন।

আসলে আজ আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের মাতব্বরির যে ধারা চলছে, সে জন্য আমরা, মানে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বই দায়ী। তাঁরা যদি গণতন্ত্রের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাশীল হতেন, জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের রাস্তাকে কণ্টকাকীর্ণ না করতেন, যদি তাঁদের দেওয়া রায়ের প্রতি আস্থাশীল হতেন, তাহলে কোনো সমস্যাই থাকত না। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘বিচার মানি, তবে তালগাছ আমার’ নীতি আঁকড়ে ধরার কারণে কখনো কখনো সমস্যা চলে যায় অসমাধানযোগ্য পর্যায়ে।

আমাদের রাজনৈতিক বিষয়ে বিদেশিদের মোড়লগিরি যে জনগণ পছন্দ করছেন না, সেটা বোধ হয় দলগুলো উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে দুই দলের সাধারণ সম্পাদক ও মহাসচিবের উপরিউক্ত বক্তব্যে। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া, তাদের ডাকে ‘পড়ি কি মরি’ করে ছুটে যাওয়া দেশের জন্য অবমাননাকর। তবে যত দিন তাঁরা আত্মমর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন না হবেন, নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধানের চেষ্টা না করবেন, তত দিন অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ