শিক্ষকতা ছিল একসময় গর্ব, অহংকার ও মর্যাদার পেশা। ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার দিল্লির পতি সে তো কোন ছার’—কবিতাটি সম্ভবত এখন আর পাঠ্যসূচিতে নেই। হয়তো সে জন্যই এখন আমাদের নিয়মিতভাবে শিক্ষক লাঞ্ছনার খবর শুনতে হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষকদের অপমানিত হওয়ার খবর শুনে আমাদের কারও লজ্জা হচ্ছে না, এমনকি শিক্ষক সমাজের নির্লিপ্ততা দেখে অবাক হতে হচ্ছে! আমরা কি একটি মূর্খের জাতিতে পরিণত হতে চলেছি?
২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে সবার সামনে ওঠবস করিয়েছিলেন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। এরপর এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে, ঘটছে। এই তো মাস কয়েক আগে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে জেল খেটেও আসতে হয়েছে। গত কয়েক দিনের মধ্যে ঘটেছে আরও দুটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এক বখাটে ছাত্র একজন শিক্ষককে এমন পিটিয়েছে যে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আর একজন কলেজ অধ্যক্ষের গলায় পরিয়ে দেওয়া হয়েছে জুতার মালা!
লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রায় সবগুলো ক্ষেত্রেই টার্গেট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষক এবং অভিযোগ—ধর্ম অবমাননা। এটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পরিকল্পিত অপচেষ্টা কি না, কে বলবে? প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসনের উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা সচেতন মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে। নড়াইলের একটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে ডেকেছিলেন। কিন্তু পুলিশের উপস্থিতিতে, তাদের পাহারায় যেভাবে তাঁর গলায় জুতার মালা পরিয়ে ছবি তুলে তা ছড়িয়ে দিয়ে অপমান করা হয়েছে, এটা মেনে নেওয়া অপরাধ। এই জুতা প্রকৃতপক্ষে পুরো জাতির গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে হিন্দুসম্প্রদায়ের শিক্ষককে কখনো কান ধরে ওঠবস করানো হচ্ছে, কখনো জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কখনো বাড়িতে হামলা করা হচ্ছে আবার কখনো পিটিয়ে মেরেও ফেলা হচ্ছে। এসব দেখেও যাঁরা নির্বিকার থাকছেন, নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, আজ যারা অন্য ধর্মের শিক্ষককে লাঞ্ছিত করছে, কাল তারা নিজ ধর্মের শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার সাহস দেখাবে না, সে নিশ্চয়তা কেউ দিয়েছে কি?
আশুলিয়া এলাকায় উৎপল কুমার সরকার নামের একজন শিক্ষককে আশরাফুল ইসলাম জিতু নামের দশম শ্রেণির এক ছাত্র ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে দুদিন চিকিৎসা নিয়েও জীবন রক্ষা হয়নি তাঁর। উৎপল সরকার ছিলেন স্কুল শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলিং করতেন। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করতেন তিনি। তাতে জিতুর ক্ষোভ ছিল শিক্ষকের ওপর। জিতু এলাকায় ‘খারাপ’ ছেলে হিসেবে পরিচিত হলেও তার অভিভাবকেরা কি তাকে কখনো শাসন করেছেন? জিতুর মতো ছেলেদের অভিভাবকদের কাছে প্রশ্নটা তোলা রইলো।