হোম > ছাপা সংস্করণ

মুক্তি রানী হত্যার বিচার

চিররঞ্জন সরকার

একটি মেয়ে নিরাপদে স্কুলে যাবে-আসবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমাদের দেশে মেয়েদের ক্ষেত্রে এই পথটাই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। আইনের শাসন ও মূল্যবোধলুপ্ত সমাজে মেয়েরা আজ সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীন। দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া হিংস্রতায় মেয়েদের কেবল সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকতেই হচ্ছে না, তাদের জীবনও দিতে হচ্ছে। কেন মেয়েদের এভাবে বলি হতে হবে? শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে আর কত দিন হিংস্রতার শিকার হতে হবে?

নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার স্কুলছাত্রী মুক্তি রানী বর্মণকে যেভাবে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর! প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় কাউসার নামে এক দুর্বৃত্ত কয়েকজন সহযোগী নিয়ে মুক্তির ওপর চড়াও হয়। ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে। মুক্তি একা ছিল না। এ সময় তার সহপাঠীরাও ছিল। তারপরও মুক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সহপাঠীরা ভয় পেয়ে চিৎকার দিলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।

সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, কাউসারের এই অপকর্মকে সহায়তা করেছে তারই বন্ধুবান্ধব, সতীর্থরা। এমন একটি পৈশাচিক কাণ্ডে বন্ধুবান্ধবদের যেখানে বাধা দেওয়ার কথা, উল্টো তারা সহযোগিতা করেছে! এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমরা যদি স্বাভাবিক মানসিক স্থিতিতে থাকি, তাহলে একটি মেয়েকে এভাবে নৃশংস হত্যার ঘটনায় কিছুতেই চুপ থাকতে পারি না। তনু হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল দেশের প্রতিবাদী মানুষ। কিন্তু অভিযুক্তরা অনেক বেশি প্রভাবশালী বলে তেমন ফল ফলেনি। তুলনায় মুক্তি হত্যার প্রতিবাদ এখনো জোরালো নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে অবশ্যই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষকে ফুঁসে উঠতে হবে। মুক্তি হত্যার প্রতিবাদে সরব হতে হবে।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, নিরাপত্তাব্যবস্থা কেবল কোনো গোষ্ঠী বা পরিবারের জন্য সীমিত নয়। এ দেশ সবার। কেবল আমলা, সেনা, ধনী, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের নয়। এখানে অপরাধকে অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। অপরাধী তা সে যে-ই হোক না কেন, তাকে আইনে সোপর্দ করতে হবে। তা না হলে এটা পরিণত হবে বর্বরের দেশে। আমরা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হব, কিন্তু খুনি-ধর্ষকদের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাব, সেটা কোনো সুস্থ প্রবণতা নয়। আর তাহলে শুধু তনু, আফসানা কিংবা মুক্তি নয়, বাংলাদেশে কোনো মেয়েসন্তানই নিরাপদ থাকবে না। কারণ অপরাধীর বিচার না হলে অপরাধ কেবলই বিস্তৃত হয়।একসময় সেই ‘পাপ’ ‘বাপ’কেও ছাড়ে না!

নাগরিক হিসেবে আমাদের নিজেদের ভূমিকাটাও মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে। আমরা ক্রমেই যেন প্রতিবাদহীন নিথর আত্মকেন্দ্রিক এক গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হচ্ছি। এতটাই অধম যে ঘোরতর অন্যায়ের বিরুদ্ধেও সরব হতে পারি না। হই না। কোথায় যেন আমাদের হাত-পা বাঁধা। আমাদের মনন বাঁধা। আমরা যে দিন দিন অস্বাভাবিক হয়ে উঠছি, মনটা যে আর নেই, থাকলেও যে পুরোপুরি ভারসাম্যে নেই, তা কিন্তু আমাদের দেখে বোঝা যায় না। রোজ সকালে নিয়মমতো আমরা হাজার হাজার, লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষ কর্মস্থলে যাই। কাজ সেরে নিয়মমতোই বাড়ি ফিরি। জীবন নিয়ে নানা স্বপ্ন দেখি। সপ্তাহান্তে পরিজনদের নিয়ে, ঘনিষ্ঠদের নিয়ে বিলাসী সময়ে ডুব দিতে চাই। আমাদের চালচলন, কথাবার্তা, সাজপোশাক, আচার-আচরণ দেখে সবাই ভাবে আমরা স্বাভাবিক, সুস্থ। কেউ বোঝে না, ভেতরে সাংঘাতিক একটা জিনিস নেই—মনটা আর নেই!

কবি স্বাভাবিকভাবেই অনেক আগে টের পেয়েছিলেন এই অসুস্থতাটা। বলেছিলেন, ‘...কেউ তা বোঝে না, সকলই গোপন, মুখে ছায়া নেই।’ বলেছিলেন, ‘...চোখ খোলা, তবু চোখ বুজে আছি।’

এ রকমই কি চলতে থাকবে? আশপাশের জগৎটা কি ক্রমে এমনই নির্মম, নিষ্ঠুর, উদাসীন হয়ে উঠবে? কেউ কারও বিপদে এগিয়ে যাব না আর? খোলা চোখেও চোখ বুজে থাকব? এর নাম সভ্যতা? এর নাম অগ্রগতি?

বর্তমানে লক্ষ করা যাচ্ছে, স্কুল-কলেজ ও রাস্তায় চলাচলের পথে ছাত্রীরা উত্ত্যক্তকরণ, যৌন সহিংসতাসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে এবং এর ফলে তাদের পড়ালেখা করা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। মেয়েদের জীবনের নিরাপত্তা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তাদের স্বাধীন চলাচল ও স্বাভাবিক জীবনধারণ বিঘ্নিত হয়ে পড়ছে। নারীর প্রতি পুরুষের আচরণ কেন সহিংস, কর্তৃত্বপরায়ণ, যৌনকামনাযুক্ত হচ্ছে?

আমাদের সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে না। একজন মেয়ে রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে যাওয়া মানে অসংখ্য পুরুষের কামার্ত, বিকৃত দৃষ্টিকে মোকাবিলা করে পথচলা। বেশির ভাগ ছেলে বড় হয় নারীকে কেবল ভোগ করার, আনন্দ করার উপযোগী মাংসপিণ্ড ভেবে। বন্ধু পরিমণ্ডলে কমবেশি সবাই নারীর শরীর নিয়ে আলাপ করে, আলাপ করে সৌন্দর্য ও কাম নিয়ে। খুবই তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে অবলীলায়। বেশির ভাগ বন্ধুসভা বা আড্ডায় এমনটাই হয়।নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার শিক্ষা খুব কম পুরুষেরই মধ্যে দেখা যায়।

সমাজবিজ্ঞানে একটা ধারণা আছে ‘সেক্সুয়াল ইন্টারঅ্যাকশন কম্পিটেন্সি’ বলে। এই ধারণায় কেবল যৌন আচরণ অর্থে নয়, বৃহত্তর অর্থে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে সুস্থ আচরণের ক্ষমতাকে বোঝানো হয়। বলা হয়, যেভাবে অক্ষরজ্ঞান শিখতে হয়, কম্পিউটার শিখতে হয়, কোনো বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করব বা করব না, তারও একটা শিক্ষা আছে। সেই শিক্ষা পরোক্ষভাবে পরিবার থেকে আসে, পঠনপাঠনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া রুচিবোধ নীতিবোধ থেকে আসে, আসে ধর্মবোধ থেকেও। অনেক ক্ষেত্রে এই বিষয়ের ওপর প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও তা অর্জন করার ব্যবস্থা করা হয়। যেসব পুরুষের কোনো সূত্র থেকেই সেই শিক্ষাটা আসে না, তারা পরিণত হয় প্রবৃত্তিসর্বস্ব, লিঙ্গসর্বস্ব এক একটা বেকুব জন্তুতে। তারা সুযোগ পেলেই হামলে পড়ে নারীর ওপর, তাদের শরীরের ওপর।

মনস্তাত্ত্বিকেরা দেখিয়েছেন, নারীর ওপর পুরুষের এ ধরনের আক্রমণের পেছনে শুধু যৌনতৃপ্তি নয়; বরং আছে শক্তি প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা। একজনকে দুর্বল অবস্থানে কোণঠাসা করে এ ধরনের শক্তি প্রদর্শনের ভেতর আছে সীমাহীন দেউলিয়াপনা, কাঙালপনা ও হীনম্মন্যতা। ভাবনার ব্যাপার এই যে আমাদের এই সমাজ ও পরিবার এমন হীন, দেউলিয়া, জঘন্য পুরুষদের বেড়ে ওঠার সুযোগ দিচ্ছে।

নারীর প্রতি পুরুষের আচরণটাও তাই স্বাভাবিক না হয়ে সব সময়ই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। নারীর প্রতি পুরুষের এই আচরণ পরিবর্তন করা ছাড়া, নারী-পুরুষ সাম্যাবস্থা তৈরির মাধ্যমে সমতা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া সমাজের সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর সেটা তৈরি করতে হলে সবার আগে পুরুষতন্ত্রের প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

পুরুষতন্ত্র শুধু মেয়েদের অত্যাচার করেই ক্ষান্ত হয় না, পুরুষ ও নারীকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। একই সঙ্গে নারীকেও নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করায়।এতে অল্প কিছু সুবিধাবাদী, শোষকশ্রেণি (সে পুরুষ হোক অথবা নারী) ছাড়া বাকি সবাই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হয়তো নারীরা বেশি হয়, কিন্তু পুরুষেরাও কম হয় না।

এই সমস্যার সত্যিকারের সমাধান হওয়া নিশ্চয়ই অনেক সময়সাপেক্ষ, তবে শুরু করতে হবে এখনই এবং সেটা শুরু করতে হবে নিজেকে দিয়েই। নারী-পুরুষের সহজ স্বাভাবিক সম্প্রীতি আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনের চর্চাটা পরিবার থেকেই শুরু হওয়া জরুরি। প্রথমে নিজের চিন্তায় বদল আনার চেষ্টা করতে হবে। এ চিন্তাকে আরও ছড়িয়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে লেখালেখি করতে হবে, কথা বলতে হবে। অনেক চিন্তা ভুল হবে, অনেক ভাবনা পরবর্তী সময়ে বোকামি মনে হবে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা প্রাণখুলে কথা বলছি, আলাপ-আলোচনা-বিতর্ক শুরু করছি, ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুই হবে না।

তবে সবার আগে দরকার বিচার ও দুর্বৃত্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তা না হলে নারী নির্যাতন, খুন, যৌন হয়রানি, পথেঘাটে অপমান-অপদস্থ হওয়ার ঘটনা কমবে না।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ