সামনের জাতীয় নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য করা যে জরুরি, সে বিষয়ে অস্পষ্ট হলেও একটা ঐকমত্য গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। কী কী শর্ত পূরণ হলে একটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়, সেটাও অজানা নয়। নির্বাচন সব সময়ই হতে হবে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ। এই শব্দগুলো আমরা মাথায় গেঁথে নিয়েছিলাম এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আদায় করতে গিয়ে। সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিল শুধু আন্দোলনে নয়—আন্দোলনকারী দলগুলোর ঐতিহাসিক সমঝোতার মাধ্যমে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় জনপ্রতিনিধিত্ব কায়েমের লক্ষ্যে সাংবিধানিক বিধিবিধানের বাইরে গিয়ে কেবল রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি নির্বাচনকালীন সরকার তখন গঠিত হয়েছিল। তার নেতৃত্বে আয়োজিত নির্বাচনটি ‘অংশগ্রহণমূলক’ও হয়। এতটাই অংশগ্রহণমূলক যে ক্ষমতাচ্যুত সেনাশাসকের দল জাতীয় পার্টিও তাতে অংশ নেয় এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসন পেয়ে অনেককে বিস্মিত করে।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের কথা ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকেও বলা হচ্ছে এটা একপ্রকার স্বীকার করে নিয়ে যে, আগের দুটি নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। দেশে গ্রহণযোগ্যতা পেলে বিদেশেও পেত বৈকি। এ দেশে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পাশাপাশি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ইতিহাসও কম উজ্জ্বল নয়। তাতে বিদেশেও আমাদের মর্যাদা বেড়েছিল। অনেকে আশা করেছিলাম, এই প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রচর্চার পথে অনেক দূর এগিয়ে যাব। সেটা আর হয়নি। হয়নি এ জন্য যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াটিই বিনষ্ট করে দিয়েছি। এতে রাজনীতির বিবদমান উভয় পক্ষেরই কমবেশি দায় রয়েছে। আমরা সবাই এসব ঘটনার সাক্ষী।
এখন কথা হলো, ২০১৪ বা ২০১৮-এর মতো নির্বাচন যেহেতু কাম্য নয়; দুইয়ের মধ্যে গড় করে যা পাওয়া যায়, সেটাও যেহেতু কোনো মানদণ্ড নয়, সে ক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কেমন নির্বাচন চাই। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন আমরা করেছিলাম, সেগুলোর মধ্যে সেরা কোনটি? এ ব্যাপারেও বিবদমান দলগুলোকে একমত হতে আমরা দেখব না। তারা যেসব নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সেগুলোকেই হয়তো বলবে গ্রহণযোগ্য! তবে এ কথা ঠিক, ওই চার নির্বাচনের কোনোটিই পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য ছিল না। এ অবস্থায় সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচনটিও যদি মানদণ্ড হয়, সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠবে—এটি অর্জন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে সম্ভবপর কি না।
নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারণা অভিনব বটে। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় এমন ব্যবস্থা নেই। এর প্রয়োজনও নেই; কেননা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধিব্যবস্থা তারা পাকা করে ফেলেছে। যারা সেটা দীর্ঘ সময়েও করতে পারেনি, তাদের কাতারে আছি আমরা। তবে এমন একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাম যে কয়েকটি নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজন করতে করতে ব্যবস্থাটি সংস্কার করে একটা পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গেলে তখন স্বাভাবিক নিয়মেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে আমরা পারব। আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম, গণতন্ত্রের ন্যূনতম পূর্বশর্ত নির্বাচন আয়োজন ও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে অন্তত কোনো দুর্গতির মধ্যে আর পড়তে হবে না।
সে আশার গুড়ে বালি ঢেলেছে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা উভয় দলই। এ ক্ষেত্রে কোনো পক্ষের ‘অবদান’ আমরা ভুলিনি। দেশের তরুণ ও কিশোর জনগোষ্ঠীর কাছে অবশ্য সবশেষ নির্বাচনগুলোর স্মৃতি তরতাজা, যেগুলো বিতর্কিত বা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা সম্ভবত তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তাদের মধ্যে এমন বাংলাদেশের প্রত্যাশাও বেশি, যেটি নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে বিশ্বে। ক্রমে হাতের কাছে আসা প্রযুক্তির কল্যাণে তারা এখন সারা দুনিয়ার খবর পেয়ে যাচ্ছে। উন্নত আর ভালো কিছু অর্জনের আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে বাড়ছে স্বভাবতই। তবে ভালো কিছু পাওয়ার অধিকার সব নাগরিকেরই আছে। এই প্রেক্ষাপটেই আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার দাবি হয়ে উঠেছে জোরদার। দু-দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্যভাবে আয়োজনে ব্যর্থ সরকারও দৃশ্যত এ দাবি অগ্রাহ্য করতে পারছে না। এটাকে একটা অগ্রগতিও বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রভাবশালী পশ্চিমা সরকার ও সংস্থাগুলোর বিশেষ আগ্রহও পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অন্তত তাদের তরফ থেকে এমনটি দেখা যায়নি। তখন তারা আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ দেশটির ‘চোখ দিয়ে’ বাংলাদেশের গতি-প্রকৃতিকে দেখত বলে কথা চালু আছে। পরিবর্তিত সময়ে তারা যে এখন নিজ চোখ দিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে দেখতে চাইছে, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের কোনো নির্বাচন নিয়ে এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এত সক্রিয়তা আর কখনো দেখা যায়নি। এই মুহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলও দেশে রয়েছে এবং তারা এখানে এসেছে সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি ও পরিবেশ দেখতে। তাদের দেওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতেই ইইউ আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। বিগত দুটি নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চাইলেও তাদের ভিসা দেওয়া হয়নি বলে খবর রয়েছে। আর সরকার এবার নিজেই আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছে ইইউ প্রতিনিধিদলকে। তারা নিশ্চয়ই এর প্রশংসা করবে। ইইউ প্রতিনিধিদলটি দীর্ঘদিন এখানে অবস্থান করে রাজনৈতিক দলসহ নির্বাচনের সব পক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। সংশ্লিষ্ট সবার বক্তব্য এবং তাতে প্রকাশিত মনোভাব বুঝে উঠতে চাইছে।
নির্বাচনের প্রধান পক্ষ বা অংশীজন অবশ্য জনগণ এবং নির্দিষ্ট করে বললে ভোটার। সাধারণভাবে তাদের দাবি একটাই—গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তারা নিশ্চয়ই পছন্দমতো দল ও প্রার্থীকে ভোট দিতে চায়। এর উপযুক্ত পরিবেশ চায় তারা। ভোটারদের মধ্যেও স্বভাবতই বিভক্তি রয়েছে, যেমন সব দেশেই থাকে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন নিয়েও তাদের একাংশে মতভেদ থাকতে পারে। কিছু উগ্র সমর্থক থাকে, যারা তাদের পছন্দ করা দলের নেতাদের মতোই চিন্তা করতে অভ্যস্ত। কেমন নির্বাচন হলে তার সমর্থিত দলের ‘সুবিধা’ হবে, সে চিন্তায় তারা মশগুল। আর এটা সব সময়ই দেখতে পাওয়া গেছে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো নির্বাচনী ব্যবস্থাটি ইতিমধ্যে পাকাপোক্ত করে ফেলা গেলে এর মধ্যে সুবিধা নিতে চাওয়া দল ও সমর্থকগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র চিন্তা চর্চার সুযোগ অবশ্য কমত। দুর্ভাগ্যবশত সেটি হয়নি।
আগামী নির্বাচন ঘিরে পশ্চিমা একেকটি প্রতিনিধিদল দেশে এলে এবং তারা চলে যাওয়ার পর একশ্রেণির রাজনীতিক ও তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে এমন আলোচনা প্রাধান্য পেতে দেখি, এটি কার পক্ষে গেল। কার জন্য স্বস্তি এবং কার অস্বস্তি! যারা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে বা দেখতে চায়, এটা তাদের জন্য অস্বস্তিকর। আমাদের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের আগ্রহ-অনাগ্রহও মূল্যায়ন করা হচ্ছে নিছক দলীয় বিবেচনায়। নির্বাচন সামনে রেখে তার অনেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া ভিসা নীতি ঘিরেও ‘স্বস্তি-অস্বস্তি’র আলোচনা প্রবল হয়ে উঠেছিল। এটা যে ৫০ বছরের বেশি আগে স্বাধীনতা লাভকারী একটি জাতির জন্য লজ্জাজনক, সেই উপলব্ধি তেমন দেখা যায়নি। এত দিন পরও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ—এ জন্য তো নিজেদেরই প্রথম লজ্জিত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যও আমরা ধরে রাখতে পারিনি, যা চরম বেদনাদায়ক।
জাতি হিসেবে আমাদের কোনো সাফল্য নেই, তা তো নয়; বিশেষ করে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সাফল্য অনেক এবং তা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। যেসব পশ্চিমা দেশ ও সংস্থা আগামী নির্বাচন নিয়ে এমনকি আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, তারাই কিন্তু এ দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির প্রশংসা করে থাকে। তারা এক অর্থে এর অংশীদারও। তাদের নেতৃত্বে গঠিত উন্নয়ন সংস্থাগুলো থেকে অব্যাহতভাবে ঋণসহায়তা নিচ্ছি আমরা। তাদের পরামর্শ মেনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়ও অগ্রসর হচ্ছি এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের বিবদমান দলগুলোয় একটা ঐকমত্যও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘নীতির ধারাবাহিকতা’ও দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর দেশগুলো আমাদের প্রধান রপ্তানির গন্তব্যও বটে এবং আমরা তো রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধিই জোরদার করতে চাইছি।
এসব দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের মডেলও আমরা অনুসরণ করছি। এর একটা প্রাথমিক আর অবিচ্ছেদ্য উপাদান হলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে গণতন্ত্রচর্চাকে ক্রমে আরও বাড়িয়ে তোলার সংগ্রাম। সেই কাজে আমরা যে অনেক পিছিয়ে পড়েছি, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ কাজে যে দ্রুতই আবার এগিয়ে যেতে হবে, সেই নিশ্চয়তাও জোরদার করা চাই। জাতীয় নির্বাচনের জন্য সময় আছে পাঁচ মাসের বেশি। এটা কম সময়; আবার কমও নয়। নির্ভর করছে আমরা এ সময়টাকে কীভাবে কাজে লাগাই, তার ওপর। যেকোনো উপায়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা এবার করতেই হবে এবং তাতে ঘটাতে হবে জন-ইচ্ছার প্রতিফলন। এটা না ঘটিয়ে আরও দীর্ঘকাল দেশ পরিচালনার আয়োজন অর্থনীতি পরিচালনায়ও সংকট হয়তো আরও বাড়িয়ে তুলবে। কেননা, সরকারে জনপ্রতিনিধিত্বের তীব্র অভাব অর্থনীতিতে উপযুক্ত নীতি আর সিদ্ধান্ত গ্রহণকেও কঠিন করে তোলে, এটা হলো অভিজ্ঞতা।