কয়েক দিন থেকেই মনটা ভীষণ খারাপ। পরপর কয়েকটি মৃত্যুসংবাদ মনটাকে মুষড়ে দিয়েছে। প্রতিদিনই তো মানুষ মরছে। একসময় করোনায় প্রতিদিন কয়েক শ মানুষের মৃত্যুসংবাদ পেতাম। সেই ভয়াবহ মহামারির সময়ে কানটা খাড়া থাকত, কখন কার মৃত্যুর খবর শুনতে হয়। যখন নিজেই তার কবলে পড়লাম, ভাবতাম আমার মৃত্যুসংবাদ পেয়েও হয়তো নিকটজনেরা এভাবেই চমকে উঠবেন।
সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সেই অভিশাপ থেকে আমরা এখন মুক্ত। এখন আবার আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে ডেঙ্গু নামের এক অতিভয়ংকর রোগ। এডিস মশা নামের এক অতিক্ষুদ্র প্রাণীর একটি ক্ষুদ্র হুল আমাদের জীবনাবসান ঘটাতে পারে।
মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ জন্মালে মরবেই—এ চিরন্তন সত্যটিকে না মেনে উপায় নেই। তবে মাঝেমধ্যে এমন কিছু মৃত্যুর খবর আসে যা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। গত কয়েক দিনে পরপর তিনটি মৃত্যুসংবাদ মনটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। স্নেহভাজন সাংবাদিক হাবিবুর রহমান খান, বাল্যবন্ধু ইউসুফ হোসেন এবং বন্ধু খান নজরুল ইসলাম হান্নানের ছোট ভাই বিল্লাল হোসেন খানের মৃত্যু হয়েছে খুব কাছাকাছি সময়ে। বন্ধু ইউসুফ ছিল ব্যবসায়ী। রাজধানীর পলওয়েল মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতিরও কর্মকর্তা ছিল সে। অমায়িক ব্যবহারের জন্য বন্ধুদের মাঝে যেমন, তেমনি পরিচিত সবার কাছেই সে ছিল সমাদৃত। ডায়াবেটিসের রোগী ছিল। হয়তো তা নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বাথরুমে একটি টুলের সঙ্গে ঘষা লেগে পায়ের ছোট্ট একটু চামড়া ছিলে গিয়েছিল। ব্যস, সেটাই কাল হলো ওর জন্য। অবহেলা করেছিল ইউসুফ। ফলে দুদিনের মধ্যেই ইনফেকশন ধরা পড়ে। যখন হাসপাতালে নেওয়া হলো, তখন তা ছড়িয়ে পড়েছে দেহের প্রায় সর্বত্র। খবর পেলাম ওকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। পরের দিনই নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ইউসুফ চলে গেল পরপারে। পেছনে রেখে গেল পরিবার ও গুণমুগ্ধ আমাদের।
বন্ধু হান্নানের ছোট ভাই বিল্লালের মৃত্যু আরও মর্মান্তিক! সেদিন (গত ২৬ আগস্ট) হঠাৎ খবর পেলাম ছোট ভাই বিল্লাল নেই! কীভাবে সে মারা গেল? জানলাম ডেমরা স্টাফকোয়ার্টার নামের বাস স্টপেজের কাছে বাসে চড়তে গিয়ে দুই বাসের চাপা লেগে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেছে বিল্লাল। বাসচালকদের বেপরোয়া গতি ৫৫ বছর বয়সী বিল্লালের জীবনের গতি থামিয়ে দিল। সড়ককে নিরাপদ করার জন্য কত কথা হলো, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-আলোচনা সভা হলো, আন্দোলন হলো, কিন্তু সড়ক আর নিরাপদ হলো না। প্রায় তিন দশক আগে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারিয়ে শুরু করেছিলেন ‘নিরাপাদ সড়ক চাই’ আন্দোলন। কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি।
গত ২২ আগস্ট সকালে একটি দৈনিক পত্রিকার একটি খবর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ‘ক্ষুব্ধ বিএনপির হাই কমান্ড’ শিরোনামের খবরটি পড়তে গিয়ে দেখলাম ওটার কারিগর আমার স্নেহভাজন সাংবাদিক হাবিবুর রহমান খান। পুরো খবরটি পড়লাম। বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের কর্মকাণ্ড ও ব্যর্থতা নিয়ে লেখা ওই রিপোর্টটি অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ মনে হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে শেয়ার করলাম। ভাবলাম রাতে ফোন করে হাবিবকে একটা ধন্যবাদ দেব। কিন্তু তা আর হলো না। তার আগেই খবর পেলাম হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে সে হাসপাতালে ভর্তি। কিছুক্ষণ পরে খবর এল, হাবিব আর নেই। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। মনে পড়ল, ফিরোজ সাঁইয়ের গাওয়া সেই গানটি—‘এক সেকেন্ডর নাই ভরসা, বন্ধ হবে রং তামাশা/ চক্ষু মুদিলে, হায়রে দম ফুরাইল...।’ দম বন্ধ হয়ে কখন কার নশ্বর জীবনের ইতি ঘটবে তা আমরা কেউ বলতে পারি না।
তরুণ সাংবাদিক হাবিবের সঙ্গে আমার পরিচয় ওয়ান-ইলেভেনের সেই দুঃসময়ে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে বিএনপির প্রচার বিভাগের কাজকর্ম আমাকেই দেখাশোনা করতে হচ্ছিল। কারণ তখন বিএনপির অনেক বীরপুঙ্গব হয় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, নাহয় ঘরের কোণে লুকিয়েছিলেন। অনেকে নাম লিখিয়েছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সংস্কারের খাতায়। বললে অনেকে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, সে সময় বেগম জিয়ার বিবৃতিতে স্বাক্ষর করার লোকও খুঁজে পাওয়া যায়নি; যদিও এখন তারাই বিএনপির হর্তাকর্তা। যাক সে কথা। সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন তাঁর ন্যাম ভবনের বাসায় প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ ব্রিফিং করেন। সেখানেই হাবিবের সঙ্গে পরিচয়। তারুণ্যের স্বাভাবিক উচ্ছলতা আর উৎসাহ সব সময় ওকে প্রাণবন্ত রাখত। ওর তৈরি করা রিপোর্টটি পড়ার পর যে ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেনি ওর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর।
একজন প্রাণবন্ত যুবকের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল হঠাৎ করেই। মাত্র ৪২ বছরের জীবন ছিল হাবিবের। আরও বহুদূর যাওয়ার কথা ছিল ওর। কিন্তু ওপরওয়ালার ইচ্ছাই তো শেষ কথা। তিনি যেমন চেয়েছেন, তেমনি হয়েছে। আমাদের তো কিছুই করার নেই।
হাবিবের মৃত্যুতে তাঁর সহকর্মী, স্বজন এবং শুভানুধ্যায়ীরা যখন শোকাভিভূত, তখন এই মৃত্যুকে কটাক্ষ করে সুদূর আমেরিকা থেকে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করলেন দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে দেশ থেকে পলাতক এক ব্যক্তি। সামসুল আলম নামের ওই ব্যক্তিটি একসময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন। যেদিন হাবিবের রিপোর্টটি প্রকাশ হয়, সেদিনই ওর মৃত্যু কাকতালীয় ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এ বিষয়টিকে নিয়ে সামসুল আলম তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছে, ‘দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার হাবিবুর রহমান খানের নামে গতকালই “ডিজিএফআই”-র বানানো একটি বিএনপিবিরোধী প্রতিবেদন নিজ নামে ছাপা হয়। কিন্তু মানুষের হাতে কাগজ পৌঁছার আগেই তার মৃত্যুসংবাদ ভাইরাল হয়ে যায়! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হাবিব বিএনপি বিট করত। মৃত্যুর পরে প্রথম শোকবাণী দেন বিএনপি মহাসচিব। আমরা তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। এখানে শিক্ষার বিষয় আছে: আমরা যা করছি বা কারও ওপর জুলুম করলে কি জানি, কেন করছি বা মাফ চাওয়ার সুযোগ পাব কি না বা আর কতক্ষণের টিকিট হাতে নিয়ে ঘুরছি?’
সামসুল আলমের কথায় এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বিএনপির সমালোচনামূলক রিপোর্টটি করে হাবিব হয়তো বড় কোনো গোনাহের কাজ করে ফেলেছিলেন এবং বিএনপির অভিশাপে তাকে অকালে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হলো। হাবিবের যে রিপোর্টটি সেদিন বেরিয়েছে, তাতে সংবাদের উৎস বলা আছে। বিএনপির ভেতরে অনুসন্ধান চালিয়েই সেই রিপোর্টটি তৈরি করেছিল। সেখানে বিএনপির বিরোধী কিছু ছিল না; বরং বিএনপির কথিত কূটনৈতিক উইংয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নে নিদারুণ ব্যর্থতার কথাই তুলে ধরা হয়েছে; যা পর্যালোচনা করে দলটি ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারত। তা ছাড়া যাদের নিয়ে ওই রিপোর্টটি তারা, মানে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। তাহলে সামসুল আলমের আঁতে ঘা লাগল কেন? এটা কি ঘোরতর বিপদের সময় নেত্রীকে ফেলে তস্করের মতো পালিয়ে যাওয়ার ফল সৃষ্ট দূরত্ব কমিয়ে আনার প্রয়াস? হবে হয়তোবা। বিপদ দেখে ‘চাচা আপনা পরান বাঁচা’ বলে ভেগে যাওয়া লোকগুলোই সাধারণত সুসময়ে এসে ভিড় করে। সামসুল আলম হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বিএনপির সুদিন দেখতে পাচ্ছেন। তাই আগে থেকেই সম্পর্কোন্নয়নের এই চেষ্টা।
মৃত্যু এক অবধারিত সত্য প্রতিটি জীবের জন্য। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। সেই মানুষের মৃত্যুকে কটাক্ষ করে আরেকজন যখন শ্লেষাত্মক মন্তব্য করে, তখন তাকে কি মানুষ বলে অভিহিত করা যায়?
মহিউদ্দিন খান মোহন, সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক