মার্চ মাস বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনগণের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ একটি মাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ২৬ মার্চ এবং স্বাধীনতার অবিসংবাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ডাকের যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটাও সাতই মার্চ। সুতরাং মার্চ মাস হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয়ভাবে বিভিন্ন আয়োজন ও উৎসবমুখর। সংগত কারণেই এর পূর্বপ্রস্তুতি চলে। লাল-সবুজে আবৃত থাকে এসব আয়োজন, অনুষ্ঠান। শ্রদ্ধা জানানো হয় ফুলে ও বক্তৃতায় মহান নেতার প্রতি। শ্রদ্ধা জানানো হয় স্বাধীনতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী সব মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি। সাভারের স্মৃতিসৌধ ফুল ও শ্রদ্ধাঞ্জলিতে ভরে ওঠে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকীর পর অনুষ্ঠান ও উৎসব আয়োজন সংগত কারণে বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া, বছরের পর বছর মার্চ মাস লাল-সবুজ পোশাকনির্ভর হয়ে থাকছে তাৎপর্য উপলব্ধির চেয়েও।
বাংলাদেশের স্থানীয় একটি নিউজনির্ভর টিভি চ্যানেলে প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণের অংশবিশেষ প্রচার করা হয়। নিঃসন্দেহে ভালো লাগে। অন্তরের ভেতর প্রতিদিন নতুন করে চেতনা জাগে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণই বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান। বলতে চাইছি, তাঁর ভাষণ মন দিয়ে শুনলে সংবিধান পাঠ হয়ে যায়। পড়া হয়ে যায়। পার্থক্য হলো, সংবিধানে ধারায় লিপিবদ্ধ থাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আত্মস্থ ও উপলব্ধিতে আনতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণের নতুন মাত্রা লাগে না। খুব সহজ ভাষায় প্রযুক্তিহীনভাবে তিনি তাঁর জনগণের মুক্তির কথা, অধিকারের কথা বলে গেছেন। একটা কথা না বলে পারছি না, টিভি চ্যানেলটিতে প্রতিদিন মহান নেতার প্রচার করা ভাষণের অংশবিশেষ শুনে আমি আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শাণিত করি, ধারালো করি। দেশপ্রেমে শুদ্ধ হয়ে উঠি প্রতিদিন একবার। মন বলে, যাঁরা বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতাকে অবলম্বন করে সক্রিয় থাকছেন, তাঁদের প্রতিদিন প্রার্থনার মতো এই ভাষণ পাঠ করা উচিত, দরকার এবং সেটা তাঁদের আত্মার শুদ্ধতার জন্য। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও অর্জিত স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারাটা হলো ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থপরতার মহোৎসব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রকৃতভাবে জাগ্রত না থাকা। যেটা হয়, হচ্ছে। যে জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, সেই জাতির সবাই স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও সবাই সমভাবে স্বাধীনতা বা অধিকার ভোগ করতে পারছেন না। দ্বিমত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই এখানে এবং কথাটা অরাজনৈতিকভাবে সত্য। সম্ভবত সেই কারণেই ৫০ বছরেও স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের জনগণের একটা অংশ এখনো দরিদ্র হয়ে বসবাস করছে।
করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দারিদ্র্যসীমা কমে এলেও প্রায় দুই বছর অতিমারি করোনার জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। সঠিক পরিসংখ্যান করা হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা পাওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু এমন বাস্তবতা তথা অতিমারির সময়েও কিছু মানুষের ধনসম্পদ ও অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। করোনার প্রকোপ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অবাক কাণ্ড হলো, এই অতিমারির সময়েও বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় যে তথ্যটি উঠে এসেছে তা হলো, এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৮ হাজার ৮৬টি।
পত্রিকান্তরে আরও জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ৯৩ হাজার ৮৯০টি অ্যাকাউন্ট ছিল, যেখানে প্রতিটি অ্যাকাউন্টে ১ কোটি টাকার বেশি আমানত ছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯৭৬টিতে। এই হিসাব অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে ৮ হাজার ৮৬টি। করোনার মতো অতিমারির মাঝেই কোটিপতির সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তথ্য বলে, করোনা অতিমারির ২১ মাসে কোটিপতি হিসাবধারী অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ১৯ হাজার ৩৫১টি। হাজার কোটি টাকা কিংবা কোটি টাকার আমানতকারী আদতে কারা, এমন প্রশ্ন মনে জাগে। কীভাবে সম্ভব হয়েছে এত টাকার মালিক হতে পারা করোনার মতো অতিমারির সময়ে! করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানাসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ ছিল। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, জেনেছি যে, আর্থিক লেনদেনমুখী উৎপাদন তেমন ছিল না, সব বন্ধ ছিল বলা যায়। উপরন্তু কর্মজীবীদের কেউ কেউ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোনো কোনো পরিবার নিম্ন মধ্যবিত্তে গিয়ে ঠেকেছে। দিনমজুর ও শ্রমিকেরা কাজের অভাবে অতিদরিদ্র হয়েছেন। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে ছিল চরম অর্থনৈতিক মন্দা। ফলে দেশে রেমিট্যান্স আসারও সুযোগ ছিল না।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, ঐতিহাসিক ভাষণ ও স্বাধীনতা অর্জনের মার্চ মাসেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য প্রতিবেদন বিস্ময়াহত করেছে। আড়ালে, অন্তরালে এমন কোনো প্রক্রিয়া ও কৌশল রয়ে গেছে কি না, যে একটা শ্রেণির ধনসম্পদ কেবল বাড়বেই। কী করে কোটিপতির আবির্ভাব হয় করোনার মতো অতিমারিতেও, তার একটা বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন পাওয়া গেলে বোঝা যেত রাষ্ট্র আদতে ভারসাম্যহীন কি না, কোথাও কোথাও। কিংবা এঁরা কারা, কোন উৎসে তাঁদের এই আর্থিক উন্নতি, সেটাও জানা হয়তো সম্ভব হতো। জনগণের তো তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নিশ্চয়ই এসব আমানতকারীর পরিচয়বৃত্তান্ত রয়েছে। তারা চাইলে পারে সরকারকে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে যে এসব নতুন ও পুরোনো কোটিপতিরা কতটা বৈধ এবং কতটা অবৈধ পন্থায় আর্থিক উন্নতি সাধন করছেন।
তবে একটা কথা ঠিক, বাংলাদেশে আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, সাংসদ কোটিপতি যেমন আছেন, ঠিক তেমনি গাড়িচালকসহ নিম্ন পদের সরকারি কর্মচারী কোটিপতিও রয়েছেন। ব্যক্তি কোটিপতি হতেই পারেন। কিন্তু তাঁর কোটিপতি হওয়ার বৈধতা রয়েছে কি না, তা দেখা দরকার। একটি দেশের উন্নয়ন কিন্তু বছর বছর কোটিপতির ক্রমবর্ধিত আবির্ভাব নয়, বছর বছর তার সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। বরং রাষ্ট্রের সব মানুষের বছর বছর আর্থিক ও সামাজিক সক্ষমতা বৃদ্ধিই হলো প্রকৃত উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশটা কিন্তু সেটাই ছিল।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক