হোম > ছাপা সংস্করণ

তাঁরা কী তবে মরে যাবেন?

ফারুক মেহেদী

আজ ওরা যখন কঠিন মনোবল আর আবেগের বিস্ফোরণে বিপন্নপ্রায়, ওরা যখন নিজেদের অধিকার আদায়ে মৃত্যুর সঙ্গে সন্ধি করছে; আমার তখন প্রায় ২৬ বছর আগের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে! ছিমছাম, সবুজ, সুন্দর, নির্মল প্রকৃতি। উঁচু-নিচু টিলা আর সমতলের মেলবন্ধনে অপূর্ব নৈসর্গিক ল্যান্ডস্কেপ। বিকেল হলেই এলএইচের (লেডিস হল) রাস্তায় জুটিদের হাত ধরে হাঁটাহাঁটি, প্রেম বিনিময়। ওই সময় ছেলেদের কাছে প্রেম ছিল সোনার হরিণ! ছেলেরা প্রেমে পড়ত আর মেয়েরা প্রেম করত, মানে সংখ্যায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অনেক কম হওয়ায়, একজন মেয়ের জন্য একই সময়ে অনেক ছেলের প্রেমের অফার পাওয়ার ঘটনাই ছিল সবচেয়ে বেশি। তো ভাগ্যবান কোনো জুটি ক্যাম্পাসের এখানে-সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রেম করছে—এ দৃশ্য প্রেমহীন বেশির ভাগ ছেলের কাছে ছিল ঈর্ষার বিষয়! তারপরও রোমান্টিক ওই সব দৃশ্য কাউকে কাউকে অপ্রার্থিব ভালো লাগায় ভরিয়ে দিত! মনে হতো–আহা, আমাদের না হয় প্রেম নেই–ওরা তো করছে, মন্দ কী!

তখন প্রেমহীন ছেলেদের শ্রান্তি-বিনোদন বলতে প্রধান ফটকের দিকে এক কিমি হেঁটে যাওয়া, টঙে বসে জম্পেশ আড্ডা, বিকেলের বাসে চড়ে শহর ঘুরে আসা, বিডিআরের সিনেমা হলে সন্ধ্যারাতে এক টিকিটে দুটি সিনেমা দেখা, সেখানের দর্শক সারিতে কখনো কখনো কোনো শিক্ষককে পেয়ে গিয়ে না দেখার ভান করা–এসবই ছিল ভালো লাগায় ভরপুর এক ক্যাম্পাসজীবন। ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই সবাইকে চেনেন। দেখা হলেই কথাবার্তা, খোঁজখবর অসম্ভব আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে তাঁদের শিক্ষকেরা ছিলেন অভিভাবকতুল্য। মিনি অডিটরিয়ামে ছাত্র-শিক্ষকেরা উৎসাহের সঙ্গে রম্য বিতর্ক করতেন। ছাত্ররাজনীতি ছিল, তবে তা ছিল অনেকটাই শৃঙ্খলিত। ভিন্নমত থাকলেও সবার সঙ্গে সবার বন্ধুত্বটাই ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। কোনো ভবনের দেয়ালে কেউ স্লোগান লেখা বা চিকা মারতে পারত না। এ আইন সবাই মেনে চলত। শিক্ষকদের অবাধ্য হয়ে কেউ কথা বলত না। অন্য দেশের সঙ্গে খেলায় বাংলাদেশ জিতে গেলে দল-মত-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই উৎসবে মাতোয়ারা হতো। ছাত্র-শিক্ষক ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের মুখে রং মাখত! আর তখন প্রগতিশীল চিন্তা ও মুক্ত সংস্কৃতিচর্চার নেতৃত্বের সামনে থাকায় আমরা তখন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারসহ আরও অনেককে আমাদের নায়ক মানতাম। কিছু হলেই আমরা তাঁদের কাছে ছুটে যেতাম! তাঁরা যা বলতেন, আমরা তা-ই করতাম। শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় তাঁরাই ছিলেন আমাদের আদর্শ। সম্ভবত এ সম্পর্কগুলো এখন প্রশ্নবিদ্ধ!

একবার হল ও ভবনের নামকরণ আন্দোলনে টানা সাত মাস বন্ধ ছিল ক্যাম্পাস। একবার আওয়ামী লীগ সরকার থাকার মধ্যেও ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কার করা হয়। কোনো চাপের মুখে তদন্ত কমিটির প্রধান ড. জাফর ইকবাল স্যারকে টলানো যায়নি। তারপরও ছাত্রলীগ জাফর স্যারের প্রতি ক্ষোভ ও অসন্তোষ পুষে রাখেনি। আবারও তাঁকে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করে শিক্ষা কার্যক্রমে সবাই স্বাভাবিক থেকেছে। টানা অবরোধে উপাচার্যসহ সিনিয়র শিক্ষকেরা অবরুদ্ধ থাকলেও পুলিশ দিয়ে আন্দোলন থামানো হয়নি।

এ রকম অসংখ্য ঘটনায় ছাত্ররা যেমন স্যারদের সহায়তা করেছে, তেমনি শিক্ষকেরাও ছাত্রদের কখনো প্রতিপক্ষ ভাবেননি। পুলিশ দিয়ে পেটানো দূরের কথা; বরং ক্যাম্পাসে পুলিশ এলেই ছাত্র-শিক্ষক এক সুরে এর প্রতিবাদ করতেন। নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতেন।

প্রায় দুই দশক আগে ছেড়ে আসা ওই ক্যাম্পাসে কয়েক দিন ধরে যা ঘটছে, তাতে রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। গণমাধ্যমে যা দেখছি, শুনছি–তা এককথায় অপ্রত্যাশিত এবং হতাশাজনক। ছাত্রীদের সাধারণ কয়েকটি সমাধানযোগ্য দাবি নিয়ে আলোচনা না করে, প্রতিরোধ ও দমনের মধ্য দিয়ে পুরো ছাত্রসমাজকে প্রতিপক্ষ করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। আমি মনে করি, এটা রীতিমতো সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব ও চূড়ান্ত অদূরদর্শিতা। ক্যাম্পাসের সাবেক গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এ রকম অসংখ্য ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এর আগে ওই ক্যাম্পাসেই ঘটে যাওয়া এর চেয়েও জটিল ও স্পর্শকাতর অঘটনও এমন নৃশংসভাবে মোকাবিলা করতে হয়নি। শীর্ষ পর্যায়ে সংযম, ধৈর্য আর সহনশীলতার এতটা অভাব এবারই প্রথম দেখলাম।

যে প্রাসাদে এখন উপাচার্য মহোদয় বসবাস করেন, মনে পড়ছে প্রায় ২১-২২ বছর আগে একবার ছাত্র আন্দোলনে ওই প্রাসাদে ভাঙচুর করা হয়। এখন যে গাছগুলো বিশাল মহিরুহ হয়েছে, সেগুলো তখন লকলক করে উঠছিল–সেগুলোরও মাথা কেটে ফেলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান স্যারের তাতে বিন্দুমাত্র ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। পুলিশ ডেকে এনে ছাত্রদের পেটানো হয়নি। এলাকাবাসীর সঙ্গে ঘটা আরেকটি আন্দোলনে আহত ছাত্রদের দেখতে তিনি রাত আড়াইটায় ওসমানী হাসপাতালে ছুটে গেছেন। তাতে তিনি ছোট হয়ে যাননি। তাঁর উদারতা ও মমতামাখা দায়িত্বশীলতাই প্রকাশ পেয়েছিল।

আজ কী দেখছি? আজ দেখছি আন্দোলনের শুরুতেই উপাচার্য মহোদয় ধৈর্যহারা। মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি পেতে তিনি পুলিশ দিয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, শটগানের গুলি ছুড়ে তাদের আহত করলেন! এত দিনে তাদের দেখতে যাওয়া দূরের কথা, সমবেদনা পর্যন্ত জানাননি।

এর প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন করছেন। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীরা একে একে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনশনস্থল থেকে থেমে থেমে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজছে। এ লেখা পর্যন্ত অন্তত ১৫ জন অনশনকারী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যাঁরা এখনো অনশনস্থলে আছেন, তাঁদের শরীর জীর্ণ, ফ্যাকাশে কিন্তু চোখে-মুখে কঠিন মনোবল। তাঁরা বলছেন, মরে যাবেন, তবু আন্দোলন ছেড়ে যাবেন না! কী ভয়ংকর শক্ত প্রাণশক্তি!

অথচ দেয়ালের ওপারে ছায়াঘেরা সুরম্য ওই প্রাসাদে উপাচার্য মহোদয় নির্বিকার, ভূমিকাহীন। তিনি দীর্ঘ শিক্ষকতায় সমৃদ্ধ, অথচ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনের ভাষা পড়তে পারছেন না। তাঁরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, অথচ তিনি হয়তো বসে বসে টিভি দেখছেন, না হলে বই পড়ছেন! তাঁর চোখের দূরত্বে দেয়ালের এপারে নিজ ক্যাম্পাসের ২০-২২ বছরের আবেগপ্রবণ অভুক্ত শিক্ষার্থীদের মনের ভেতরের দ্রোহ আর ক্ষোভের লেলিহান শিখায় তাঁরা পুড়ছেন, অথচ তিনি একচুলও নড়ছেন না। খিদের জ্বালায় তাঁদের ডুকরে ওঠা গোঙানি তাঁর কানে পৌঁছাচ্ছে না। তিনি হয়তো পণ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কেউ যদি মরেও যায়, তবু তিনি স্নিগ্ধ কণ্ঠে দরজাটি খুলে, তাঁদের মাথায় হাত বোলাতে যাবেন না। তিনি হয়তো ভাবছেন বিনা কারণে কেনই-বা নিজেকে ছোট করবেন তাঁদের কাছে! তিনি তো উপাচার্য। তাঁর তো আপস মানায় না। যদি এমনটি না হতো তাহলে তিনি হয়তো এত সময় নিতেন না। একজন মানবিক মানুষের এত সময় নেওয়ার কথা নয়। যাঁরা তাঁকে চান না, যাঁদের মনে তাঁর প্রতি ক্ষোভ কিংবা দ্রোহের উদ্রেক হয়েছে, সেখানে ক্ষমতাকে তুচ্ছ করে সাধারণের কাতারে ফেরা তাঁর জন্য হয়তো কঠিনই বটে।

আমাকে আমাদের সমসাময়িক অনেকে কয়েক দিন ধরে ফোন করছেন। তাঁদের অনুরোধ, বড় কোনো দুর্ঘটনার আগে, কারও মৃত্যু বা এ রকম অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটার আগেই, যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাটির যাতে সমাধান হয়, এমন ব্যবস্থা করা। সম্ভব হলে সরকারের শীর্ষ কারও সঙ্গে কথা বলে কিছু করা যায় কি না, তা দেখা। আসলে কে করবে ব্যবস্থা? কার কথা কে শোনে? উপাচার্য মহোদয় তো নিজেই সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তিনি নিজেই এখন সমস্যার কেন্দ্রে। অনশনকারীদের একটাই দাবি–তিনি যেন চলে যান। এখন তিনি তা আমলে নিচ্ছেন না বলেই আন্দোলনটি এখনো শেষ হচ্ছে না! হয়তো তিনি এর শেষ দেখতে চান। এর আসলে শেষ কোথায়? ওরা কী তবে জীবন দিয়ে তাঁদের দাবি প্রতিষ্ঠা করে যাবেন? এটাই চান উপাচার্য মহোদয়? তাঁদের ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে’ যে তাঁরা যে আন্দোলন করছিলেন, সেটি শেষ পর্যন্ত সঠিক। এটুকু না দেখা পর্যন্ত তিনি কি নমনীয় হবেন না? তিনি কি নিজের হৃদয়খানিকে একটু কোমল করে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে তাঁদের তৃষ্ণার্ত মুখে পানি তুলে দেওয়ার চেষ্টাটাও করতে পারেন না? তাঁরা কী তবে মরে যাবেন?

লেখক: ফারুক মেহেদী,সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ