হোম > ছাপা সংস্করণ

কোটিপতির উদ্বেগজনক সংখ্যা বৃদ্ধি

চিররঞ্জন সরকার

আর্থিক সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। ভুগছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু এর মধ্যেও দেশে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। অন্তত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব তা-ই বলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, কোটি টাকার বেশি জমা আছে—এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা এক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ হাজার ৫৩৯টি। এর মধ্যে শেষ তিন মাসে এই সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬০টি। চলতি বছরের মার্চের শেষে কোটি টাকা আমানতের অ্যাকাউন্ট ছিল ১ লাখ ৩ হাজার। জুনের শেষে যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮ হাজারে।

কোটিপতি হওয়া, কোটিপতির সংখ্যাবৃদ্ধি কোনো খারাপ কিছু নয়। কোনো দেশে যদি ক্রমাগত কোটিপতির সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেটা তো বরং খুব ভালো কথা। মানুষ বড়লোক হওয়ার জন্যই না এত কিছু করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে কোটিপতি হচ্ছে একটা মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। তাঁরা সৎপথে থেকে, পরিশ্রম করে, নিয়মিত কর পরিশোধের মাধ্যমে কোটিপতি হচ্ছেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোটিপতি হচ্ছেন দুনম্বরি করে, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে, সরকারি বিধিব্যবস্থা লঙ্ঘন করে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে।

বাংলাদেশে কোটিপতি হওয়ার জন্য তেমন কোনো সাধনা বা পরিশ্রম করতে হয় না; এখানে ‘অলৌকিক’ উপায়ে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া যায়। রাষ্ট্র ও সরকার স্বয়ং এ ব্যাপারে যথাযথ সহায়তা ও প্রণোদনা দিয়ে থাকে। কিছুসংখ্যক মতলববাজ, কপর্দকহীন, অর্বাচীনকে রাতারাতি কোটিপতিতে রূপান্তরিত করতে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির কোনো জুড়ি নেই।

পাকিস্তান আমলে মাত্র ২২টি পরিবারের কোটিপতি হিসেবে খ্যাতি ছিল। ওই ২২ পরিবারের কোটিপতি হওয়ার পেছনেও অবশ্য রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও ভোজবাজি কাজ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোটিপতি হওয়ার এই ধারা আরও অনেক বেশি বিকশিত হয়েছে। এখন আমাদের দেশে কোটিপতির মোট সংখ্যা কেউ জানে না। বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব দিয়েছে, তার চেয়ে কোটিপতির সংখ্যা এখন বহুগুণ বেশি।

বিশিষ্ট সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী একবার দরবার-ই-জহুর কলামে লিখেছিলেন, সন্তান উৎপাদনের যেমন একটিমাত্র প্রক্রিয়াই রয়েছে, তেমনি কোটিপতি হওয়া যায় একটিমাত্র পন্থাতেই—চৌর্যবৃত্তি ও দুর্নীতির মাধ্যমে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সাধারণত আইনের আওতার মধ্যে এদিক-সেদিক অনেক রকমারি করে বড়লোক বা কোটিপতি হতে হয়। আর এখানে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার নিয়ম। রাতে ফাটা স্যান্ডেল, ছেঁড়া জুতা তো সকালেই নতুন বাড়ি, নতুন গাড়ি। এখানে এমনকি ভাঙা স্যুটকেসওয়ালার পরিবারও কোটিপতি বনে যায় সহজেই।

আমাদের দেশের কোটিপতিদের সঙ্গে অন্য দেশের কোটিপতিদের পার্থক্য রয়েছে। অন্য দেশের কোটিপতিরা দেশকে শিল্পায়িত করার ব্যাপারে অবদান রাখেন। দেশের টাকা দেশের ব্যাংকে জমা রাখেন। কিন্তু আমাদের দেশের ফাটকা কোটিপতিরা শিল্পায়নে পুঁজি বিনিয়োগে বড় বেশি আগ্রহ দেখান না। নামকাওয়াস্তে শিল্পকারখানা দেখিয়ে দেশীয় ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেন না। ওদিকে তথাকথিত এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ‘সিক’ দেখিয়ে আরও টাকা নেওয়ার অথবা ঋণ মওকুফের চেষ্টা চালান। অথবা ঋণখেলাপির ‘অভিজাত ক্লাবে’ নাম লেখান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকায়। ব্যাংকিং খাতে এত পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবারই প্রথম। শুধু চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ২১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা বেড়েছে। বাংলাদেশে ঋণ খেলাপের সংস্কৃতিটা টাকা মেরে দেওয়ার ধান্দা থেকে আসা। ঋণখেলাপি আসলে একটি চক্র। এতে শুধু যে ঋণগ্রহীতা আছেন তা-ই নয়, ঋণদাতা ব্যাংকাররাও আছেন। ব্যাংকাররা দেওয়ার সময়ই জানেন কোন ঋণটা আদায় হবে, কোনটা হবে না। এখন বাংলাদেশে বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়া। কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে খাতির করুন। সরাসরি যদি তা না পারেন, তবে কোনো মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা কিংবা প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তিকে ধরুন। তাঁর মাধ্যমে কোনো একটা ব্যাংকে যান। একটা বায়বীয় প্রজেক্ট বানান। তারপর একটা বড়সড় ঋণ নিন। এটা অবশ্যই ১০০ কোটি টাকার ওপরে হতে হবে। সেখান থেকে টেন পার্সেন্ট যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিন। কেননা, আপনার এই ঋণে তাঁদের অবদানটাই প্রধান। এরপর নো চিন্তা ডু ফুর্তি। লোনের টাকায় বাড়ি-গাড়ি কিনে আয়েশ করে চলুন। সমাজে আপনি সম্মান পাবেন, নইলে সম্মান কিনে নিতে পারবেন। আর বেশি ঝামেলা হলে কানাডা কিংবা অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমান। কেউ আপনার টিকিটিও ছুঁতে পারবে না।

কাজেই দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা আমাদের জন্য মোটেও আনন্দের কোনো খবর নয়। কারণ, গরিব মানুষের সংখ্যা কমছে না; বরং বাড়ছে। বাড়ছে ধনবৈষম্য। অল্প কিছু মানুষের হাতে সব অর্থ-সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আমাদের দেশে বর্তমানে একটা বিকৃত পুঁজিবাদীব্যবস্থা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। সাধারণভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মনে করা হয়, চাহিদার মাপকাঠি হলো বাজার, আর বাজার নির্ভর করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপরে। যদিও এ ব্যবস্থায় গরিবেরা বাজারব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে যায়। একজন মানুষের শীতকালে সোয়েটার কেনার ক্ষমতা নেই, তার মানে এটা নয় যে তার সোয়েটারের চাহিদা নেই। পুঁজিবাদ বাজারকে বিচার করে মানুষের প্রয়োজন দিয়ে নয়, মানুষের কেনার ক্ষমতা দিয়ে। আবার মুনাফার স্বার্থে নিজেই লোক ছাঁটাই করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে। কাজেই, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অপুষ্টি, অশিক্ষা ইত্যাদির জন্য দায়ী মূলত শাসনব্যবস্থা, ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ উৎপাদন ও অসম বণ্টনব্যবস্থা।

আজ দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদের মালিক জনসংখ্যার ২-৩ শতাংশ লুটেরা ধনিক। তাদের সম্পদের পরিমাণ কেবল বাড়ছে। কোভিডের সময় বেড়েছে। এখন চরম আর্থিক সংকটের মৌসুমেও বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে লুটপাটকারী কোটিপতির সংখ্যা। অন্যদিকে প্রদীপের নিচে নিকষ কালো অন্ধকারের মতো সর্বনিম্ন অর্থনৈতিক স্তরের প্রায় সাড়ে তিন কোটি বাংলা মায়ের হতভাগ্য সন্তানের সম্পদ গত এক বছরে আরও কমেছে। তীব্র মূল্যস্ফীতির কারণে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করতে না পেরে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে বহু পরিবার। দেশ-বিদেশের একাধিক সমীক্ষায় স্পষ্ট, বিপজ্জনক উচ্চতায় পৌঁছেছে আর্থিক বৈষম্য। এমন পরিস্থিতিতে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি অত্যন্ত উদ্বেগজনকও বটে। কোটি কোটি মানুষের সহায়-সম্পদ কমে যাওয়ার বিপরীতে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির পকেট স্ফীত হওয়া কি উদ্বেগের বিষয় নয়?

পুনশ্চঃ ক্লাসে শিক্ষক এক ছাত্রকে বলছেন, বলো তো রায়হান, তোমার বাবা শতকরা ১০ টাকা হারে সুদে ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা লোন নিলেন, এক বছর পর তিনি কত টাকা ফেরত দেবেন?
রায়হান : এক টাকাও না স্যার।
শিক্ষক : গাধা! এখনো এই অঙ্কই জানো না?
রায়হান : আমি অঙ্ক জানি, কিন্তু আপনি আমার বাবাকে জানেন না স্যার!

দেশটা সত্যিই এখন এমন ‘রায়হানের বাবা’দের দখলে চলে যাচ্ছে!

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ