হোম > ছাপা সংস্করণ

বাঙালি সভ্যতা-সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার দায়

সুতপা বেদজ্ঞ

সংস্কৃতিচর্চা মানবিক মানুষ হতে শেখায়, মানুষে-মানুষে মমত্ববোধ গড়ে তোলে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, মন্দ চিন্তা থেকে দূরে রাখে, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়। দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলে সংস্কৃতি।

সভ্যতা-সংস্কৃতি শব্দযুগল পাশাপাশি যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি এরা হাত ধরাধরি করে টিকে থাকে। সংস্কৃতির হাত ধরে সভ্যতা এগিয়ে চলে, বিকশিত হয়। সভ্যতা মানুষকে সমালোচনা গ্রহণ করতে শেখায়, আত্মসমালোচনার পথ বাতলে দেয়। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ, মমতার বন্ধন গড়ে তোলে সংস্কৃতি। মোটকথা, মানুষের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করে চলা, তাকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া সভ্যতার অন্যতম কাজ। সভ্যতা মানুষকে প্রগতিমুখী বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী করে তোলে। সভ্যতার হাত ধরে এগিয়ে চলা সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষে মানুষে বন্ধনকে মজবুত করে।

সভ্যতার সঙ্গে শিক্ষার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। শিক্ষা ছাড়া সভ্যতা একচুল অগ্রসর হতে পারে না। আর এসব কাজই সম্পাদিত হয় সংস্কৃতির ওপর ভর করে। দীর্ঘদিনের জীবনাচরণের ছন্দময় গতিময়তার শেকড় সমাজে প্রথিত হতে হতে সংস্কৃতি নামক মহিরুহটি সমাজে বিস্তার লাভ করে। বাঙালি সংস্কৃতিও তেমনিভাবে বিস্তার লাভ করেছে এবং এখনো টিকে আছে।

সভ্যতা-সংস্কৃতি শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় না এবং এটা কোনো আবদ্ধ বিষয়ও নয়। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বেশির ভাগ বাঙালিই অস্ট্রো-এশিয়াটিক। দ্রাবিড় গোষ্ঠীও এর মধ্যে মিশেছে। এই দুটি প্রধান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ছাড়াও বাঙালির মধ্যে তিব্বতি, চীনা এবং সেমেটিক রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে। তেরো শতকে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের পরপরই ভারতীয় ভূখণ্ডের সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বখতিয়ার খিলজি তুর্কি ছিলেন। তাঁর সৈন্যরা তুর্কিস্তান, উজবেকিস্তান, ইরান কেউবা আফগানিস্তান থেকে এসেছিল। পনেরো শতকে উত্তর এবং পূর্ব আফ্রিকার হাবসিরাও এসেছিল এই ভূখণ্ডে। এদের বেশির ভাগই এই অঞ্চলের মেয়েদের বিয়ে করে স্থায়ীভাবে থেকে যায় এবং ধীরে ধীরে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায়। তাদের সংস্কৃতিও আমাদের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে। এরপর কেটে গেছে কয়েক শ বছর। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিচর্চায় এসেছে নানা পরিবর্তন।

আমাদের মতো বহু মত-পথ সম্প্রদায়ের দেশে ধর্ম ও সংস্কৃতি মিলেমিশে ঘেঁষাঘেঁষি করে টিকে থাকে, বিকশিত হয়। তা সত্ত্বেও ধর্মীয় ও জাতীয় সংস্কৃতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। সেই পার্থক্যকে সতর্কতার সঙ্গে চর্চায় আনতে না পারলে ঘটতে পারে নানা ধরনের বিপত্তি। এমনকি বহু প্রাচীন সংস্কৃতি পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের আচার-আচরণ উপাসনার ধরন ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় ধর্মীয় সংস্কৃতি ভিন্নতা নিয়েই সমাজে টিকে থাকে। জাতীয় সংস্কৃতির অবয়ব বহুমাত্রিক এবং তা ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির মতোই বাঙালির অভিন্নতা তার ভাষায়, খাদ্যাভ্যাসে, পোশাকে, চেহারায়, সাহিত্য ও শিল্পকলাচর্চায় এমনকি আবাসন নির্মাণেও।

এ কথাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মানুষের দেশে কখনো কখনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়তে পারে। তাতে দোষের কিছু নেই।

তখন সংস্কৃতিটাই প্রধান হয়ে ওঠে এবং তাতে ধর্মের কোনো ক্ষতি হয় না। যেমন আজকাল বিয়ের গায়েহলুদের সংস্কৃতি সব ধর্মের অনুসারীরাই প্রায় একই কায়দায় পালন করেন। নাটক-সিনেমা বা আজকালকার সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা কায়দাকানুনও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে আচার-অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে দেখা যায়। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি নারী-পুরুষ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। তাঁরা রেমিট্যান্স যেমন পাঠাচ্ছেন সঙ্গে সঙ্গে চলে আসছে সেই সব দেশের সংস্কৃতি। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে অন্য দেশের সংস্কৃতির প্রভাব পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু কতটুকু গ্রহণ করলে আমাদের সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়।

এ ক্ষেত্রে চিন্তার কথা হচ্ছে, অনেকটা বাধাহীনভাবেই বাঙালি সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটছে। বাঙালি সংস্কৃতি বারবার রাজনীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে—এ কথা সবারই জানা। রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে বিভেদ। ১৯৪৭ সালে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশ তৈরির সিদ্ধান্ত সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। বাঙালিরাও জোরেশোরে হিন্দু-মুসলিমে, অর্থাৎ ধর্মের পরিচয়ে ভাগ হতে থাকে। জাতীয় বা সংস্কৃতিগত পরিচয় ক্রমেই গৌণ হয়ে ওঠে। শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ধর্মে-ধর্মে বিদ্বেষ, হিংসা জিইয়ে রাখার কৌশল সংস্কৃতিকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এপার বাংলা-ওপার বাংলা তৈরি হয়। এক বাংলায় বাঙালি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, অন্য বাংলায় বাঙালি হিন্দু। ফলে যা ঘটল তা হচ্ছে দুটি প্রধান ধর্মমতকে ঘিরেই বাঙালি সংস্কৃতি আবর্তিত ও বিকশিত হতে থাকল। দুই দেশের শাসকগোষ্ঠীই এটিতে বাধা না দিয়ে বরং তা অগ্রসর করতে নানা কায়দাকানুন জারি রাখল। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে-মিশিয়ে জাতিগত পরিচয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলো। এখন পর্যন্ত শাসকশ্রেণির প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ মদদে দুই দেশেই ধর্মীয় উন্মাদনা বেড়ে চলেছে। মানুষ যত ধর্মের নেশায় ডুবে থাকে, ততই শাসকদের সুবিধা। এই রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের আশকারায় জাতীয় সংস্কৃতি ক্রমেই পথ হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। গত দুই দশকে বাঙালি দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে কি পোশাকে, কি ভাষা ব্যবহারে এমনকি খাদ্যাভ্যাসেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। ধর্মীয় পোশাক ও সাজসজ্জায় নিজের ধর্মীয় পরিচয়কেই প্রধান হিসেবে বাইরে প্রদর্শন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন অনেকে। অন্যদিকে মুসলিম ধর্মাবলম্বী
নারী-পুরুষের পোশাক ও ভাষা প্রক্ষেপণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

ধর্মীয় সম্প্রদায়নির্বিশেষে বহু বাঙালি নিজের সংস্কৃতি ছেড়ে এখন অন্য সংস্কৃতি ভালোবাসতে শুরু করেছে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এমনকি জাতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ‘অবরোধ’ পর্যন্ত ঘোষণা করছে। তারা বাঙালি সংস্কৃতিকে ধর্মীয় মোড়কে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। কিছু ধর্মব্যবসায়ীর বিভাজন মানসিকতার কারণে মানুষে মানুষে সৃষ্টি হচ্ছে বিভেদ, হিংসা, হানাহানি। আবার আধুনিকতার নামে উন্মাদনার যে সংস্কৃতি প্রচার করা হয়, তার ক্ষতিকর প্রভাবও কম নয়। দুই-ই জাতীয় সংস্কৃতি টিকে থাকার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। একই জল-হাওয়ায় বড় হওয়া সত্ত্বেও শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে একে অপরকে সহ্য পর্যন্ত করতে না পারার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, এর ফলাফল যে ভয়াবহ, তার প্রমাণ মিলছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, লালন সাঁইজির ভক্তদের ওপর হামলা, শাহ্ আবদুল করিমের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টাসহ নানা অপকর্মের মধ্য দিয়ে। বাংলা ভূখণ্ডে একটি গোষ্ঠী বরাবরই জাতীয় সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছে। স্বার্থবাদীরা নিষিদ্ধ সংস্কৃতি বলে সমাজে যা প্রচার করে, তা আসলে শিল্পকলা, সংস্কৃতির একটা অংশমাত্র। এর বাইরে সংস্কৃতির বিশাল জগৎ রয়েছে। সেই জগৎকে তারা কেবল আড়ালই করে না, তাকে বিনষ্টও করতে চায়।

আজ আর বলতে বাধা নেই অনেক সৃজনশীল সাংস্কৃতিক বিদ্যালয় এখন (নাচ-গান-আবৃত্তি-ছবি আঁকা) শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের নাচ-গান-নাটক-থিয়েটার শেখাতে আগ্রহী নন। পাড়ার লাইব্রেরিতে শিশু-কিশোরেরা পড়তে যায় না। বিদ্যালয়গুলো তাদের পাঠাগারগুলো শিশু-কিশোরবান্ধব করে তোলার ক্ষেত্রে মনোযোগী নয়। এর কোনোটিই সংস্কৃতি বিকাশের জন্য শুভ খবর নয়। সৃষ্টিশীল সংস্কৃতি বিমুখতা মানুষকে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে। সুকুমার বৃত্তিকে গলা টিপে ধরে। তার ছাপ ক্রমেই প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। সংস্কৃতিচর্চার অভাবে আমাদের শিশু-কিশোরেরা একাকিত্ব আর হতাশায় ভুগছে, জড়িয়ে পড়ছে নানা সামাজিক অপরাধে। শিশুকাল থেকে চলন-বলন-পোশাক সবই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। অর্থ উপার্জন এবং পরকালের ভীতি নিয়ে বড় হচ্ছে এই প্রজন্মের অধিকাংশ শিশু।

সংস্কৃতিচর্চা মানবিক মানুষ হতে শেখায়, মানুষে-মানুষে মমত্ববোধ গড়ে তোলে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, মন্দ চিন্তা থেকে দূরে রাখে, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়। দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলে সংস্কৃতি। কাজেই নিজস্ব সংস্কৃতিকে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে সুস্থ সমাজ বা জাতি গঠন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি জাতীয় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখাও কঠিন। বাঙালি জাতিগত সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতেই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বাঙালি জাতির সম্পদ। একে রক্ষা করা ও প্রগতির পথে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া আমাদের দায়।

আজকের প্রজন্ম ও সচেতন মানুষেরাও বোধকরি সে দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। এই দায়িত্ব বোধ থেকেই আগামীর জন্য, আমাদের সন্তানদের স্বার্থে বাঙালি সভ্যতা-সংস্কৃতিচর্চা ও একে টিকিয়ে রাখতে মনোযোগী হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

লেখক: সুতপা বেদজ্ঞ, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ