নড়াইল শহরের খাল ভরাট করে বিভিন্ন মার্কেট নির্মাণসহ নানা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এতে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
নড়াইল পৌর ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, নড়াইল পৌর এলাকায় ছোটবড় প্রায় ১২টি খাল ছিল। মোট চার কিলোমিটার দীর্ঘ এসব খালের সিংহ ভাগই ভরাট করে মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
খাল ভরাট করে নির্মাণ করা পৌরসভার মার্কেটগুলো হলো চৌরাস্তা এলাকার গাজী আলী করিম মার্কেট, মিজান সড়ক মার্কেট, পুরোনো বাসটার্মিনাল এলাকার জিয়া প্লাজা, পৌর সুপার মার্কেট ও টিঅ্যান্ডটি অফিসের সামনের মার্কেট।
ব্যক্তি মালিকানাধীন মার্কেটগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চৌরাস্তা এলাকায় মোল্লা মার্কেট, তারিক স্কয়ার, ডিসির বাংলোর সামনের মার্কেট ও চৌধুরী মার্কেট, পুরোনো বাসটার্মিনাল এলাকার স্টেডিয়াম মার্কেট, ফাতেমা সুপার মার্কেট, শিকদার মার্কেট, ইসলাম মার্কেট। এসব মার্কেট খাল ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের চৌরাস্তার প্রধান খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে নড়াইল পৌরসভা নিয়ন্ত্রণাধীন ১০টি মার্কেট ও জেলা পরিষদের চারটি মার্কেট। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন ছোট-বড় প্রায় ২০টি মার্কেট গড়ে উঠেছে খাল ভরাট করে।
পৌরসভার মহিষখোলা এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা ছামি মোল্লা জানান, শহরের প্রধান খালটি ছিল প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা। শহরের পানি কেন্দ্রীয় ঈদগাহের পেছন দিয়ে দুর্গাপুরের বিল হয়ে কাজলা নদীতে গিয়ে পড়ত। কিন্তু বর্তমানে প্রধান খালের অস্তিত্বই নেই।
শহরের প্রধান খালের ওপর জেলা পরিষদের মার্কেট, রেডক্রিসেন্ট ভবন নির্মিত হওয়ায় খালটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। রূপগঞ্জ জামে মসজিদের সামনের খালের ওপর গড়ে উঠেছে চারটি পৌর সুপার মার্কেট এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন আরও দুটি মার্কেটসহ রূপগঞ্জ টাউন ক্লাব।
শহরের মুচিপোলের খালের ওপর গড়ে উঠেছে রবিকুন্ডু সুপার মার্কেট ও নন্দী মার্কেট। এ ছাড়া মুচিপোল এলাকা থেকে রামকৃষ্ণ আশ্রম, রাইফেল ক্লাব, গরু হাটখোলার সামনে দিয়ে যে খালটি বাসভিটা খালের সঙ্গে মিশেছে তাঁর ওপর নির্মিত হয়েছে শিকদার মার্কেট, মাজেদ মিয়ার বিল্ডিং ও রাইফেল ক্লাব।
পুরোনো বাসটার্মিনাল এলাকার বাসিন্দা দেবনাথ (৬৩) বলেন, ‘সদর হাসপাতালের সামনের খাল দিয়েই শহরের ভওয়াখালি এলাকার পানি দুর্গাপুর বিল হয়ে তুলারামপুরের কাজলা নদীতে গিয়ে পড়ত। আধা কিলোমিটার লম্বা এ খাল ভরাট করে ব্যক্তি মালিকানাধীন পাঁচটি মার্কেট বানানো হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদ, ওলামা লীগ নেতার চেম্বার।’
নড়াইল-মাগুরা সড়কের দুপাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সরকারি ও বে-সরকারি অফিস ও বাসভবন। খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে পুলিশ সুপার, গণপূর্ত বিভাগ, সিভিল সার্জন, সড়ক ও জনপথ বিভাগের অফিস।
নড়াইল-যশোর সড়কের শীতলাতলা মন্দির সংলগ্ন সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্ট হাউজটি খালের কালভার্টের ওপর নির্মিত। অথচ এই খাল দিয়ে ভওয়াখালি গ্রামের পানি চিত্রা নদীতে গিয়ে পড়ত।
নড়াইল পৌরসভার ভওয়াখালি এলাকার একটি অংশের পানি ঠাকুরবাড়ির পেছনের খাল হয়ে নড়াইল-যশোর সড়কের পাশে কালভার্টের নিচ দিয়ে চিত্রা নদীতে পড়ত। সেই কালভার্টের ওপর সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্টহাউস নির্মাণ করায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ওই এলাকায় প্রায় ১০০ পরিবার জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছেন।
ভবনের পেছনের বাসিন্দা রমেশ বিশ্বাসের স্ত্রী কাকলি বিশ্বাস (৬২) বলেন, ‘৫৫ বছর আগে বউ হয়ে এ গ্রামে এসেছি। তখন এলাকার পরিবেশ কত সুন্দর ছিল। ভারী বর্ষণ হলেও কখনো বর্ষার জল জমা থাকেনি। এখন নানা ধরনের বিল্ডিং হয়ে সে পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টিতেই ঘরের মধ্যে হাঁটু জল হয়ে যায়।’
ভ্ওয়াখালি গ্রামের বাসিন্দা কলামিস্ট অধ্যাপক প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য (৯০) বলেন, ‘রক্ষক হয়ে যদি ভক্ষকের ভূমিকায় থাকে তাহলে সে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বেই। কালভার্টের ওপর সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্টহাউস নির্মাণ করায় খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার শিকার হতে হয়। বিষয়টি পৌরসভাকে একাধিকবার অবগত করেও কোনো লাভ হয়নি।’
পৌর মেয়র আঞ্জুমান আরা বলেন, পৌর এলাকায় যেসব নর্দমা ছিল সেগুলো বন্ধ করে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় এ জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণেই সামান্য বৃষ্টিতেই শহর ও শহরতলির বিভিন্ন অঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে। দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পৌর এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থাপনা ও বাড়ি-ঘর গড়ে তোলায় সামান্য বৃষ্টিতেই হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। খাল দখল করে যারা বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হবে। শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হবে।’