অবশেষে বাণিজ্যমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবসায়ীদের আল্লাহর কাছে সোপর্দ করেছেন। মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে, তখন তাকে আল্লাহর কাছে বিচার চাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। ২০০২ সালের ৯ মে ঢাকার রামপুরায় বাবার কোলে থাকা ২০ মাসের শিশু নওশিন ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী শোকগ্রস্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন’। কথাটি তখন সর্বত্রই বেশ মুখরোচক আলোচনায় পরিণত হয়েছিল। এর মধ্যে একবার এক সেমিনারে এফবিসিসিআইর সভাপতি বলেছেন, তিনি চোর-বাটপারদের সভাপতি নন; অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাঁরা চোর-বাটপার আছেন, যাঁরা নানা কারণ দেখিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়ান, তাঁদের সভাপতি তিনি নন।
রোজার মধ্যেই এই তিনটি বক্তব্য ভুক্তভোগী রোজাদারদের জন্য খুবই উপাদেয় হয়েছে। যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁরা খুব ভালো করেই বোঝেন কী হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে এবং কী হলে দাম স্বাভাবিক থাকে। আজ থেকে প্রায় চার শ বছর আগে মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলের কথা একটু ভাবা যাক। সেই আমলে বাংলায় জিনিসপত্রের দাম খুব কম ছিল। সমকালীন ব্যক্তিদের জীবনী দেখে বোঝা যায়, বাজার ও দোকান জিনিসপত্রে ভরা থাকত। প্রধান প্রধান শহর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, হুগলি, ঢাকা ছাড়াও তখন হাটবাজারে সয়লাব ছিল। মুর্শিদ কুলি খাঁ রাজধানী মুর্শিদাবাদের বাজারদর ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সম্পর্কে সব সময় অবহিত থাকতেন। এসব বিষয়ে তাঁর কড়া নজরদারি ছিল। তিনি তাঁর কর্মচারী দিয়ে বাজারের প্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্যতালিকা প্রস্তুত করাতেন। গরিব মানুষেরা বাজারে কী দামে জিনিসপত্র কেনে তা জেনে নিয়ে উভয় ধরনের তালিকা প্রণয়ন করতেন। যদি দেখা যেত গরিব খরিদদার এক পয়সা বেশি দিয়ে কোনো জিনিস কিনতে বাধ্য হয়েছেন, তখনই তিনি দোকানি, মহলদার ও ওজনদারদের ডেকে পাঠাতেন। তাঁদের জন্য ছিল কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা, গাধার পিঠে চাপিয়ে তাঁদের সারা শহর ঘোরানো হতো।
সেই যুগে টাকার ক্রয়ক্ষমতা ছিল বেশি এ জন্য বেতন ও মজুরি কম হলেও সাধারণ মানুষের জীবনধারণে কোনো অসুবিধা হতো না। ১৭০০ থেকে ১৭২৪ সাল পর্যন্ত এক টাকা ব্যয় করে চার থেকে পাঁচ মণ মোটা চাল পাওয়া যেত। এই সময়ে একজন দিনমজুরের দৈনিক আয় ছিল এক পণ বারো গন্ডা কড়ি, যা একটি টাকার চেয়েও অনেক কম। একজন কেরানির মাসিক আয় ছিল চার টাকা ছয় আনা। পুলিশের দারোগার আয় চার টাকা, তাঁতিদের দেড় টাকা। একজন কুশলী কারিগরের দৈনিক আয় ছিল দশ পয়সা। যখন এক মণ চিনির দাম চার টাকা, এক মণ তেল দুই টাকা, ঘি সাড়ে দশ সের এক টাকা, এক মণ মাখন সাড়ে চার টাকা। দুই টাকা ব্যয় করে একজন পুরুষ তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে মাস কাটাতে পারতেন।
মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে দ্রব্যমূল্য জানতে বাজারে বিভিন্ন ধরনের লোক নিয়োগ করা হতো। কিন্তু আজকের দিনে মিডিয়া ও যোগাযোগব্যবস্থার কারণে কোথায় কত টাকায় কী বিকিকিনি হচ্ছে তা জানা খুবই সহজ হয়ে পড়েছে। বাজারে আমদানির খবরও খুব দ্রুত পাওয়া যায়। বাণিজ্যমন্ত্রী এবং এফবিসিসিআইর সভাপতি দুজনের বক্তব্যে ব্যবসায়ীদের দুর্নীতিকে দায়ী করা হয়েছে। তার মানে সুস্পষ্টই দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু ব্যবস্থা গ্রহণের পালা।
১৯৫০ সাল থেকেই দেখা গেছে, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আমদানির স্বল্পতার কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় এবং একবার দাম বেড়ে গেলে তা আর শিগগিরই কমে না। এটি দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে যেমন সঠিক, তেমনি বাসভাড়া থেকে শুরু করে সর্বত্রই তা বিরাজমান। এই পরিস্থিতিতে যারা দ্রব্যমূল্যের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে, সেই কর্তৃপক্ষ কী করল?
বহুবার লেখার মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছি যে দেশের নীতিনির্ধারকেরা দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে খুবই অসচেতন। দেশের মন্ত্রী-আমলা-সাংসদদের এসবের খবর নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কখনো বিনা মূল্যে, কখনো নামমাত্র মূল্যে এবং কখনো ভেট হিসেবে এসে থাকে। আর যাঁদের টুপাইস ইনকাম আছে, তাঁদের বেলায় এসব কিছুই যায়-আসে না। যাঁদের গায়ে লাগে, তাঁরা এ দেশের কোটি কোটি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ।
প্রতিবেশী দেশ ভারতেও দেখেছি প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমএলএ তাঁরা বাজারে যান, বাজার করেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে তর্কাতর্কি করেন এবং দ্রব্যমূল্যকে একটা সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান। যদিও দ্রব্যমূল্য বর্তমানে কখনো কখনো ওই দেশেও বেসামাল হয়ে পড়ে। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে রীতিমতো যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি করেন। আমরা চিরকালই দেখে এসেছি, যখন দ্রব্যমূল্যের সংকট দেখা দেয়, তখনই টিসিবির গাড়ি নামে। পত্রপত্রিকায় টিসিবির গাড়ির সামনে অসহায় মানুষের হুড়োহুড়ি লক্ষ করা যায়। ব্যবসায়ীদের বড় লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায় যেকোনো পালা-পার্বণ, উৎসব এবং বিশেষ করে রমজান মাস।
রমজান মাসে সারা দিন রোজা রাখার পর সবাই একটু ভালো খাবার চান। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা দামটা বাড়িয়ে দেন। ক্ষুধার্ত মুসল্লি আপাতত ওই দামেই জিনিসপত্র কিনে ক্ষুধা নিবৃত্ত করেন। বাজারের মহাজনেরা প্রায়ই ধর্মভীরু। লম্বা দাড়ি নিয়ে বাজারে বসে দ্রব্যের দাম কেন বেশি হচ্ছে তা বাহাস করে থাকেন। আর আমাদের দেশের ওয়াজ-মাহফিলে যেসব মোল্লা দিনরাত বেহেশত-দোজখ নিয়ে বাহাস করে যাচ্ছেন, তাঁরা দ্রব্যমূল্যের অনাচারীদের নিয়ে তেমন কোনো কথা বলেন না। কারণ তাঁদের ওই বাহাসের টাকা, বিপুল পরিমাণ অর্থ, ওই দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীরা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে যত মসজিদ-মাদ্রাসা আছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের উদ্যোক্তা এই তথাকথিত ধর্মভীরু ব্যবসায়ীরা। ইফতারের বেশ আগেই ইফতারিসামগ্রী বিক্রি শেষ হয়ে যায়। তার মানে উচ্চবিত্তরা এই দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি পরোয়াই করেন না। নিম্নবিত্তকে বাধ্য হয়ে মুড়ি ও পানি খেয়ে ইফতার সারতে হয়। এই মাসটি যেমন রোজাদারদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র মাস, তেমনি ব্যবসায়ীদের জন্য এই মাসে সোনা ফলাতে হয়। এই মাসের উদ্বৃত্ত কামাই দিয়ে হজে যাবেন, আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইবেন এবং ফিরে এসে বুভুক্ষু মানুষের ওপর আবার খড়্গ নিয়ে বসবেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী কি আল্লাহর দরবার থেকে এসব ব্যবসায়ীর ওপর শাস্তি বিধানের জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছেন? আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হিসেবে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে তাঁদের ওপর কি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন না? পারবেন না। কারণ রাজনীতি সেখানে একটা বড় অন্তরায়। যেমন এই সময়ে চাঁদাবাজ, দুর্নীতিপরায়ণ আমলা, রাজনীতিবিদ সবাইকে টুপাইস দিতে হয়। শুধু টুপাইস দিলেই হবে না। সামনেই আসছে কোরবানির ঈদ, কোরবানির গরু কেনার টাকাটারও ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের দেশের মন্ত্রী-আমলারা কি জানেন না সৌদি আরবসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে রোজার সময় সব জিনিসের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে? আর পশ্চিমা বিশ্বে ক্রিসমাস বা অন্য উৎসবের সময় একই অবস্থা হয়। বাংলাদেশে হাটবাজার প্রচুর। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের জায়গা প্রচুর নয়। কিছু মোকামের ওপর হামলা করলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব এবং তাতে ক্ষুধার্ত আত্মা যদি তৃপ্ত হয় তার জন্য যথাযথ সওয়াব সরকারের লোকজনও পাবেন।
ঢাকা ছাড়াও বড় বড় শহরে এখন টাকার ছড়াছড়ি। এক প্লেট ইফতারির দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকা। লক্ষ-কোটি টাকা উড়ে যাচ্ছে ইফতার পার্টিতে। সেখানে প্রচুর খাবার অপচয় হচ্ছে। সেই অপচয়ের একটা অংশ দিয়ে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত রোজাদার পেট ভরে খেতে পারেন। এর বিচার যখন কোথাও পাওয়া যাবে না, তখন বাণিজ্যমন্ত্রীর মতোই বলতে হয়, আল্লাহ এই সব লোকের বিচার করবেন। হয়তো ইহকালে হবে না, পরকালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।