কাল থেকে শুরু হচ্ছে ভাষার মাস। অবধারিতভাবেই বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা, বৈদ্যুতিন মাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্রই ভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। ভাষার মাসে বইমেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই অনেক উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। শহীদ মিনার হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কেন্দ্র। আত্মপরিচয়ের খোঁজে ফেব্রুয়ারি মাসের অনুষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব আছে, কিন্তু সেটা অনুভূতির সঙ্গে মিশে না গেলে মুশকিল। তখন তা হয়ে ওঠে লোকদেখানো।
এই ঘেরাটোপ থেকে ভাষা আন্দোলনকে বের করে আনতে হলে বেশ কিছু কাজ করার আছে। মোটাদাগে যে কথাগুলো এখানে বলা হবে, তার বাইরে আরও অনেক কিছুই আছে, যা নিয়ে পরামর্শ দিতে পারেন গবেষকেরা।
দুই. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেক বিষয়েই আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমরা যে অনেক কিছুই না জেনে দেদার মন্তব্য করে দিই, সেটা ফেসবুক বুঝিয়েছে। কোনো বিষয়ে জানা থাকুক আর না-ই থাকুক, মন্তব্য করা সহজ, এটাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটা শিক্ষা।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ভাষাবিষয়ক, জাতীয়তাবিষয়ক, স্বাধিকারবিষয়ক কোনো মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকেই এমন সব আজগুবি কথা বলতে থাকেন, যা আমাদের অর্জনের একেবারে বিপরীত ভাষ্য প্রকাশ করে।
যেমন বড় একটা ভুল হয়, যখন কেউ বলে বসেন, আমরা উর্দুকে হটিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। এটা শুধু ভুল নয়, এটা অসত্য। অনেকেই জাতীয়তাবাদী মোহে এই অসত্যকে প্রকাশ করে থাকেন। মূল জায়গাটা হলো, কোনো ভাষার প্রতিই সে আন্দোলন কোনো বিদ্বেষ দেখায়নি। উর্দুকে হটিয়ে দেওয়ার মতো কোনো দাবিই ভাষাসংগ্রামীরা তোলেননি। দাবি ছিল খুবই সাধারণ: সংখ্যাগুরু নাগরিকদের ভাষা বাংলা যেন রাষ্ট্রভাষা হয়। বাঙালিরা বাংলাকে একক রাষ্ট্রভাষা হিসেবেও দাবি করেনি।
এ বিষয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে আমরা ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির কথা বলি। সেদিন করাচিতে পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশন বসেছিল। সেখানে গণপরিষদের কার্যবিবরণীর ভাষা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলার সপক্ষে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তা তীব্র আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিল।
কী বলেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত? তিনি তো তাঁর বক্তব্যে উর্দুকে নাকচ করে দেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমার এই প্রস্তাব আমি কোনো সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার মনোভাব থেকে পেশ করিনি। পূর্ববঙ্গ হিসেবে বাংলাকে যদি একটি প্রাদেশিক ভাষা বলা হয়, তবে এ কথা সত্য যে, আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা। ৬ কোটি ৯০ লক্ষ যদি সমগ্র পাকিস্তানের অধিবাসীর সংখ্যা হয়, তাহলে তার মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে।
সভাপতি মহোদয়, আপনিই বলুন, একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার নীতি কী হওয়া সংগত? একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হবে সেই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষা। আর সে কারণেই আমি মনে করি, আমাদের রাষ্ট্রের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বা প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে বাংলা।
…যেকোনো রাষ্ট্রের ভাষা হতে হবে এমন যে, সাধারণ মানুষ সে ভাষা বুঝতে পারে। অথচ রাষ্ট্রের ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ তার এই গণপরিষদ তথা পার্লামেন্টের কার্যবিবরণীর ভাষা জ্ঞাত নয়। আমি তো বুঝিনি উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে ভাষার প্রশ্নে লক্ষ মানুষের বাংলা ভাষা কেন ব্যবহৃত হতে পারবে না?’
এটাই ছিল গণপরিষদে ভাষাবিষয়ক আলোচনা। কিন্তু এ কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, সেদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান কড়া সমালোচনা করেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে। শুধু কি তাই? বিতর্কের শেষে যখন উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলার প্রস্তাব ভোটে দেওয়া হয়েছিল, তখন পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ সদস্যরাও এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।
খাজা নাজিমুদ্দীন সে সময় ছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী। তিনিও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করেন। ১৯৫২ সালে এই খাজা নাজিমুদ্দীন ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ মন্তব্যের পরই ভাষা আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব অগ্রাহ্য হওয়ার পর ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং কয়েকটি স্কুলে তাৎক্ষণিকভাবে ধর্মঘট হয়। মিছিল হয়। ছাত্রসভা হয়। তমদ্দুন মজলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ বৈঠকে ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১ মার্চ তমদ্দুন মজলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের একটি বিবৃতি প্রচারিত হয়। তাতে স্বাক্ষর ছিল তমদ্দুনের পক্ষে আবুল কাশেম এবং ছাত্রলীগের পক্ষে নাইমউদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান ও আবদুর রহমান চৌধুরীর। এই পটভূমির কথা মনে রাখলে ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী কর্মকাণ্ড বোঝা সহজ হবে।
চার. ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্র ধরেই আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গভীরে প্রবেশ করতে পারব। উৎসুক পাঠক নিশ্চয়ই সে পথটি খুঁজে বের করবেন। আমরা আরেকটি দিক নিয়ে কিছু কথা বলব এখন।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এখন সর্বজনবিদিত। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের ঘটনাক্রমও আগ্রহীদের অজানা নয়। ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করতে চেয়েছেন, কেউ কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবেই স্মৃতিভ্রষ্টতার কারণে ভুল তথ্য দিয়েছেন। ইতিহাসের স্বার্থে সে বিষয়গুলো চিহ্নিত করা দরকার।
এ বিষয়ে একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। ২০০৪ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় এম এ বার্নিক নামের এক ভাষা আন্দোলন গবেষকের ধারাবাহিক লেখা ছাপা হয়। তাঁর লেখা ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। তিনি তাঁর লেখায় প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিশই মূল ভূমিকা পালন করেছে। এ কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রগতিশীল ছাত্রনেতাদের তমদ্দুনের নেতা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুনের ভূমিকা ছিল, কিন্তু ১৯৫২ সালে তমদ্দুন আর সে রকম শক্তিশালী ছিল না। এ কথাটা অনেকেই ভুলে যান।
এম এ বার্নিকের ছড়ানো বিভ্রান্তির একটি উদাহরণ দিই। ২০০৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এম এ বার্নিকের যে লেখাটি প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হয়, তাতে ভাষা আন্দোলনকারী দুজন ছাত্রনেতার পরিচয় ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হয়। এম এ বার্নিক তাঁর লেখায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের সে সময়কার ছাত্র বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দারকে যথাক্রমে তমদ্দুন মজলিশের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির দপ্তর সম্পাদক এবং মজলিশের ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার নেতা হিসেবে বর্ণনা করেন। সাঈদ হায়দার মজলিশের ছাত্রফ্রন্ট ‘ছাত্রশক্তি’র সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন বলেও বর্ণনা করেন বার্নিক। সে সময় বদরুল আলম বেঁচে ছিলেন না। ভাষাসংগ্রামী সাঈদ হায়দার প্রথম আলো অফিসে ফোন করে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমি তখন সেই পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলাম। সাঈদ হায়দার বলেন, তিনি কোনো দিনই তমদ্দুন মজলিশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এরপর তিনি একটি প্রতিবাদলিপি পাঠান। প্রতিবাদের মূল কথা ছিল, ‘আমি তমদ্দুন মজলিশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। প্রকৃত তথ্য হলো, ওই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে তমদ্দুন মজলিশের বা ছাত্রশক্তির কোনো ইউনিট ছিল না।…আমার বিশিষ্ট বন্ধু জনাব বদরুল কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত ছিল না।…আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের চরিত্রহননে ক্ষুব্ধ হয়েছি।’
পাঁচ. কথাগুলো বলা হলো প্রকৃত ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রত্যয় নিয়ে। মাতৃভাষার অধিকারই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল প্রেরণা। সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। সেই সঙ্গে, আমরা যেন কোনোভাবেই সেই বলিষ্ঠ ইতিহাসকে বিকৃত না করি।