অপরাধ কমবেশি সব সমাজেই রয়েছে। আমাদের সমাজেও এর প্রবণতা কখনোই শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায়নি। মাঝেমধ্যে অপরাধের বিস্তার এবং ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া দেখে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত হতে দেখা যায়। রাষ্ট্রে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বহু ধরনের প্রতিষ্ঠান এখন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাতদিন কাজ করে যাচ্ছে। দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণবিজ্ঞান নামক একটি বিভাগ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু আছে। এই বিভাগগুলো থেকে অপরাধ সংঘটন, বিস্তার এবং কমানোর উপায় নিয়ে নানা ধরনের সেমিনার, গবেষণা ও লেখালেখি হচ্ছে। পুলিশ এবং একাডেমিক পর্যায় থেকে দেশে অপরাধপ্রবণতা হ্রাসে নানাভাবে কাজ করা হচ্ছে। নানা অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধী ধরাও পড়ছে, আদালতে ব্যাপকসংখ্যক মামলার বিচার চলছে, অনেকেই সাজা পেয়ে কারাভোগও করছে। অনেক বড় বড় অপরাধী দেশের ভেতরে ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার অনেকে দেশের বাইরে বসবাস করছে। সেখান থেকে দেশের অভ্যন্তরে অনুসারীদের দিয়ে নতুন নতুন অপরাধ করে চলছে।
দেশে প্রকৃতপক্ষে কত ধরনের অপরাধ রয়েছে, কতসংখ্যক ব্যক্তি এসব অপরাধের সঙ্গে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে জড়িত, তার সঠিক পরিসংখ্যান খুব সহজে পাওয়ার নয়। নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং দলগতভাবে অনেকেই নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে। একের পর এক অপরাধ করে চলছে। অনেকের কাছেই অপরাধ একটি পেশা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এভাবেই গোটা সমাজে নানাভাবে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, অপরাধীর সংখ্যাও অগুনতি। সবাই আর্থিক অনটনে পড়ে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, এমন নয়। এরা মূলত অসৎ সঙ্গে অবচেতন মনেই সর্বনাশা এই পথে জড়িয়ে পড়ে। তারপর পেছনে ফেরার আর পথ থাকে না। তবে বেশির ভাগ অপরাধীই অনিয়ম, বৈষম্য, অর্থনৈতিক সংকট, শিক্ষা এবং কর্মদক্ষতার অভাবে বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ তখন হয়ে ওঠে ক্ষমতা, অর্থবিত্তে যথেষ্ট শক্তিশালী। ক্ষমতার অপব্যবহার, জোরজবরদস্তি, শক্তিপ্রয়োগ, আতঙ্ক ছড়ানো কিংবা নানা ধরনের সন্ত্রাসীকাজে যুক্ত থেকে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিতে ‘সাহসী’ হয়ে ওঠে। এরা তখন সমাজকে দুর্বল মনে করে, নিজেদের শক্তিধর হিসেবেই ভাবতে থাকে। জীবন তাদের কাছে তখনই কেবল এক অন্য রকম জগৎ হিসেবে ধরা দেয়। যেখানে বিবেক, নৈতিকতা, মানবিকতা, যুক্তিবাদিতা, সামাজিকতা তুচ্ছ জ্ঞাত হতে থাকে।
আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা যেহেতু এখনো নিয়মশৃঙ্খলা, আইন, বিচার, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং জীবনবোধ গঠনের মৌলিক ধারণায় যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। দুর্বলতা ও দোদুল্যমানতায় ওঠানামা করছে। তাই সমাজের নিম্ন অবস্থান থেকে উচ্চ অবস্থান পর্যন্ত অপরাধ এবং অপরাধীদের বেড়ে না উঠতে দেওয়া, আইন ও বিচারের সম্মুখীন করা, আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়া ইত্যাদি সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির নেতৃত্বের কাছ থেকে যথাযথভাবে পাচ্ছে না। ফলে অপরাধপ্রবণতা ও অপরাধীদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা সামাজিক শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা মোটের ওপর অসম্ভব হয়ে উঠছে। অধিকন্তু সমাজের সর্বত্র প্রভাবশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকেই সমর্থক, লাঠিয়াল এবং প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য এসব অপরাধীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হলেও আশ্রয়-প্রশ্রয় কিংবা ব্যবহার করে থাকে। দেশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অনেকেই বিত্ত সম্প্রসারণে এ দুর্বৃত্তদের নানাভাবে ব্যবহার করে থাকে। দুর্বৃত্তরাও বিত্তশালী ও ক্ষমতাধরদের আশ্রয়-প্রশ্রয় থেকে একের পর এক অপরাধ করতে মোটেও দ্বিধা করে না। ফলে আমাদের সমাজের দ্বিচারিতার বিষয়টি মোটেও অজানা কিংবা অস্বীকার করার উপায় নেই। এভাবে চলতে চলতে সমাজ এখন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। এর গতি ও পরিণতি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে যাচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা শহরে বেশ কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গত জানুয়ারিতে ৯টি, ফেব্রুয়ারিতে ১২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মার্চ মাসে আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে প্রকাশ্যে শাহজাহানপুরের ব্যস্ত রাস্তায় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গাড়িতে শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ হত্যা করে পালিয়ে যান। তাঁর গুলিতে রিকশারোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতি মারা যান। মাসুম মতিঝিলকেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম শুটার। দীর্ঘদিন তিনি শুটারের ছদ্মাবরণে জীবনযাপন করলেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার মাধ্যমে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। টিপু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি পালিয়ে বগুড়ায় একটি হোটেলে উঠেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে এখন আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে নিয়েছে। মাসুমের মতো অপরাধীর সংখ্যা ঢাকায় কম নয়। এঁরা ‘ওপরতলার’ অপরাধী। এঁদের অপরাধের পেছনে রাজনীতি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইন্ধন প্রত্যক্ষভাবেই থাকে। সে কারণেই বারবার অপরাধ করেও সমাজে ভালো মানুষের ছদ্মাবরণে ঘুরে বেড়ায়। সমাজ এদের অপরাধী হিসেবে সব সময় চিনতেও পারে না। দ্বিতীয় যেই হত্যাকাণ্ডটি সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে তা হলো, মিরপুরের কাজীপাড়ায় গত ২৬ মার্চ ভোরবেলায় ডেন্টিস্ট আহমেদ মাহী বুলবুলকে ছুরিকাঘাতে হত্যা। হত্যাকারীরা সাধারণ কোনো ছিনতাইকারী নয়। তাঁর সঙ্গে থাকা টাকা কিংবা মোবাইল ফোন তারা নেয়নি। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। জানা গেছে, সন্দেহভাজন চার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় যে ১২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার ৫টিই মিরপুর এলাকায়।
২৫ মার্চ সবুজবাগে বাসায় ঢুকে গৃহবধূ তানিয়া আক্তারকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে ‘নামীদামি’ কিলারদের হাতে। এরা কোনো সাধারণ অপরাধী নয়। যাঁদের হত্যা করেছে, তাঁরাও এসব অপরাধীদের হয় স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন নতুবা কারও না কারও স্বার্থরক্ষায় পথের কাঁটা সরাতে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। প্রীতি অবশ্য মাসুমের গুলি ছোড়ার টার্গেটে ছিলেন না, রিকশারোহী হওয়ায় তিনি ঘটনাচক্রে মারা গেলেন। ঢাকা শহরে এ ধরনের টার্গেট হত্যাকাণ্ড এখন বেড়েই চলছে। এর বাইরে রাতের ঢাকায় এখন ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে অনেকেই সর্বস্ব হারাচ্ছেন। তাঁরা অনেকে শারীরিকভাবে আক্রান্তও হচ্ছেন। ছিনতাইকারী অপরাধীর সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা-উত্তরকালে কর্মহারা নিম্ন আয়ে যাদের সংসার চলছে না, তারা এখন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের কাজে পথে নেমেছে। আন্তজেলা বাস চলাচলে চুরি-ডাকাতি রাতের বেলায় বেড়ে গেছে বলেও অভিযোগ উঠছে। বোঝা যাচ্ছে, সম্পদ-টাকাপয়সা লুটে নেওয়া অপরাধীরা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, অন্যান্য শহরেও দিনে ও রাতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা আগের চেয়ে এখন ঊর্ধ্বমুখী। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদেশে রিক্রুটিংসহ নানা কাজে দালাল ও অপরাধীদের চাঁদাবাজি ও সংযুক্তি আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে। মধ্যস্বত্বভোগী, ডিলার, আড়তদার এমনকি বড় বড় মিলার, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে কম অপরাধ করছে না।
অপরাধপ্রবণতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কতটা ভয়ংকরভাবে বিস্তৃত হয়েছে, তা একটু তলিয়ে দেখলেই হাতেনাতে ধরা পড়ে। কিন্তু ওই অপরাধীদের টুঁটি চেপে ধরার কেউ নেই। প্রশাসনেও ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম ঠেকানো যাচ্ছে না। সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির পণ্য বিতরণে অব্যবস্থার পেছনে নিহিত রয়েছে অপরাধপ্রবণতা ও মানসিকতা। ফ্যামিলি কার্ড বিতরণে কোথাও কোথাও অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও দলবাজির খবর প্রকাশিত হলেও কারোরই কোনো চক্ষুলজ্জা নেই, প্রতিকার করারও যেন কেউ নেই! হতদরিদ্রদের জন্য এই ব্যবস্থাটি চালু করলেও কার্ড প্রাপ্তিতে অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন। কারা করেছেন? তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের কারও কারও নাম উচ্চারিত হলেও তাঁদের কাছে যুক্তির অভাব নেই। তাঁদের যেন সব কার্ড বিতরণ করতে দেওয়া হলেও তাঁরা হতদরিদ্রদের চোখে দেখতেন না। আবার ডিলারদের অনেকেই পণ্য নিয়ে যা করছেন তার পেছনে রয়েছে দুর্নীতির মানসিকতা। বারবার পণ্য কিনে যাঁরা অন্যদের পণ্য পেতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরাও কম যান না। এভাবে গভীরভাবে দেখলে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বত্র অপরাধের মানসিকতা এতটাই প্রবল যে অপরাধমুক্ত জীবনযাপন করার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও অনেকের পক্ষেই তা কঠিন হয়ে উঠছে। সমাজ এবং মানুষ শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ছে এসব প্রবণতার বেড়াজালে। প্রশ্ন হচ্ছে উন্নত দেশ, সমাজ ও জীবন এভাবে কি নিশ্চিত করা যাবে? উত্তর হচ্ছে, না। উপায় তাহলে কী? শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইনের শাসন, সুশাসন এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে আদর্শ, ন্যায়পরায়ণতার চর্চার কোনো বিকল্প নতুন প্রজন্মের নেই।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট