হোম > ছাপা সংস্করণ

কিন্তু কাকে বলে আধুনিকতা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের অর্জন যে অনেক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একটি অর্জন হচ্ছে আধুনিকতা। এই দাবিটা অস্বীকার করা যাবে না। বায়ান্নর আগের বাঙালি মুসলমান বৈষয়িকভাবে যেমন, মানসিকভাবেও তেমনি বেশ পশ্চাৎপদ ছিল। জাতীয়তাবাদ বলতে তারা দ্বিজাতিতত্ত্বকে গ্রহণ করেছিল; অর্থাৎ ধর্মকেই জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি বলে ধরে নিয়েছিল। সেটা পশ্চাৎপদতার একটি প্রমাণ বৈকি। বায়ান্নতে সে ভাষাকে চিনল, ধর্মের চেয়ে ভাষা যে অধিক জরুরি, সেটা বুঝল। এটি খুব বড় রকমের একটা অগ্রগতি বটে। বলা যায়, বাঙালি মুসলমানের মধ্যে ইহজাগতিকতার বোধ তৈরি হলো। পূর্ববঙ্গে তখন আর হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান রইল না, সবাই বাঙালি হয়ে উঠল।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু আধুনিকতার অন্য উপাদানও তো রয়েছে। সেগুলো কী? চারদিকে তাকালে মনে হবে আধুনিকতার একটা বড় উপাদান হচ্ছে দেশপ্রেম বর্জন। আমরা এখন খুবই আধুনিক হয়েছি; অর্থাৎ হালকা ও চটপটে হয়ে উঠেছি। হালকা হওয়ার লক্ষণ হচ্ছে দেশপ্রেম না থাকা। দেশপ্রেম এতটা বোঝা বৈকি। অন্যের কথা ভাবতে হয়। দেশ কোন পথে, সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হয়। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন আসে। সে একটা বিড়ম্বনা, অপ্রয়োজনীয় বোঝা বহন করার ক্লান্তি ও গ্লানি দুটোই দেখা দেয়। দেশপ্রেম না থাকলে তরতর করে চলা যায়, সিঁড়ি পেলে ওঠা যায় সহজে। চটপটে হওয়ার সঙ্গেও দেশপ্রেমের বর্জন জড়িত বৈকি। যেমন ধরা যাক, ইংরেজি বুলি। সেটা তো খুবই ফুটে উঠেছে। উচ্চবিত্ত শিক্ষিত মানুষেরা এখন খাঁটি বাংলা বলে না, ইংরেজির সঙ্গে বাংলা মিশিয়ে কথা বলে। তারা দ্বিভাষী মানুষে পরিণত হয়ে গেছে। এই শ্রেণির ছেলেমেয়েরা নির্ভুলভাবে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত হচ্ছে। ওই মাধ্যমে যত শিক্ষিত হচ্ছে, ততই যে আধুনিক হচ্ছে, তাতে সন্দেহ কী? ইন্টারনেট এসেছে, যার অর্থ ইংরেজির চর্চা কেবল শিক্ষায় ও মুখের বুলিতে নয়, দৈনন্দিন জীবনাচরণেও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আধুনিকতার অর্থ দাঁড়াচ্ছে স্মার্টনেস। আর সেই স্মার্টনেস আসছে ইংরেজি ভাষার প্রায় সার্বক্ষণিক ব্যবহার থেকে। নিরিখ ওটাই।

ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করে, প্রাণ দিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনকে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা নয়, বাংলা ভাষার একটা রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করে ফেললাম; আমরা সবাই আধুনিক হলাম, কিন্তু পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে যে আমাদের মধ্যে যারা যত বেশি কম বাংলা ভাষা ব্যবহার করছে, তারাই তত বেশি আধুনিক বলে পরিচিত হচ্ছে। তাহলে কি আমরা উর্দুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু বাংলার পক্ষে করিনি? সেটা কী করে সম্ভব? আন্দোলনের লক্ষ্যই তো ছিল বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা! বিষয়টা নিয়ে ভাবার কারণ আছে বৈকি। এ কথা বললে মোটেই মিথ্যা বলা হবে না যে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা না করে ইংরেজিকেই যদি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে রেখে দেওয়া হতো, তাহলে বায়ান্নর ওই অভ্যুত্থান ঘটত না। বাঙালি মধ্যবিত্ত ইংরেজিকে মেনে নিয়েছিল এবং আগের প্রজন্ম ইংরেজি না শিখে যে ভুলটা করেছিল, পরের প্রজন্ম তা করত না, তারা ইংরেজি শিখত এবং আধুনিক হতো, এখন যেমনটা হচ্ছে। এখন তো মনে হয় আগের প্রজন্মের আপাতব্যর্থতার ক্ষতি পূরণ করে চলেছে।

কিন্তু ভাষা আন্দোলনের যে শক্তি, সেটা এল কোথা থেকে? এসেছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থেকে। রাষ্ট্র বুঝেছে যে বাংলাকে না মানলে চলবে না, আর চলবে না যে সেটা সাধারণ মানুষ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়েই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের যে রায়, সেটা ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। ওই রাষ্ট্র মানুষকে শোষণ করছিল। পাকিস্তান মানেই ছিল পাঞ্জাবি সামরিক-অসামরিক আমলাতন্ত্রের শাসন। ১৯৫৪ সালের রায় নতুন করে বের হয়ে এসেছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এবং তারপর সত্তরের নির্বাচন ওই রায়কে পাকাপোক্ত করে দিয়েছে। বাঙালি নেতৃত্বের পক্ষে তখন আর আপস করার কোনো উপায় ছিল না।

যাকে আধুনিকতা বলি, সেটা তখন ছিল দেশপ্রেমের মধ্যেই নিহিত। যে দেশপ্রেমের ভিত্তি হচ্ছে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা। রাষ্ট্র ছিল পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক। লড়াইটা সামন্তবাদের তুলনায় তাকে আধুনিক কে না বলবে? কিন্তু রাষ্ট্র যখন পুঁজিবাদী হয়ে যায়, আধুনিকতা তখন পুঁজিবাদের শোষণ ও নির্যাতনের স্রোতে আত্মসমর্পণে থাকে না, থাকে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোতে। বায়ান্নতে বাঙালি সেটাই করেছিল। সামন্তবাদীরা বলতে চাইত বাংলা মুসলমানদের ভাষা নয়, এতে হিন্দুয়ানির গন্ধ আছে। ওদিকে পাকিস্তানি পুঁজিবাদীরা পূর্ববঙ্গকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করার অভিপ্রায়ে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর। এটা আজ বিশ্বব্যাপীই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এই যুগে আধুনিকতার মূল ভিত্তিটাই হচ্ছে পুঁজিবাদী হওয়ার চেষ্টা এবং ভাবভঙ্গি সবই অচেতন কৌতুকাভিনয় বটে। আধুনিকতা আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দক্ষতার ভেতরে লুকিয়ে নেই; বরং ইন্টারনেট, কম্পিউটার, তথ্যপ্রযুক্তি, মোবাইল ফোন—এসবের ব্যবহার মানুষকে অসামাজিক প্রাণীতে পরিণত করে ফেলবে—এমন আশঙ্কাই আজ দেখা দিয়েছে। আর অসামাজিকতার মধ্যে আধুনিকতা তো নেই-ই; বরং প্রভূত পরিমাণে আদিমতা রয়েছে। আদিম মানুষ খুবই বিচ্ছিন্ন ছিল। আজ সমাজ থেকে উৎপাটিত, আত্মকেন্দ্রিক, কৃত্রিম যে মানুষ নিজেকে আধুনিক ভাবছে, সে তার অজান্তে ওই আদিমতাতেই ফিরে গেছে। পুঁজিবাদী সভ্যতা তাকে ওই আদিমতার দুর্দশার ভেতর নিষ্ঠুরভাবে নিক্ষেপ করেছে।

আমরা পশ্চাৎপদ হতে প্রস্তুত নই। সে জন্যই তো দেখা যাচ্ছে যে পাগলা হাওয়ার মতো প্রাইভেট মোটরগাড়ি আসছে, কিন্তু চলতে পারছে না, রাস্তার মধ্যখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আটক অবস্থায় পড়ে থাকছে। মস্ত মস্ত দালান উঠছে, কিন্তু মানুষের নিরাপত্তা এক রত্তি বাড়ছে না। পাড়া-মহল্লায় বখাটেদের উৎপাতে মেয়েদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

অন্যত্র আর কী তাকাব, একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনের নতুন দেশীয় রীতির ওপরই দৃকপাত করা যাক না কেন। আগের কালে একুশে ফেব্রুয়ারি শুরু হতো অতিপ্রত্যুষে, প্রভাতফেরি দিয়ে, সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দিনের যথা সূত্রপাত ঘটে। এই বিবেচনা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। পয়লা বৈশাখের উদ্‌যাপনও আমরা ওভাবেই শুরু করি। একাত্তর সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারিতে ওই রীতিই প্রচলিত ছিল। তারপর দেশ যেই স্বাধীন হলো, অমনি ১৯৭২-এর একুশ পালনের সময় থেকে উদ্‌যাপন শুরু হয়ে গেল মধ্যরাত্রিতে। এটা ইউরোপীয় রীতি, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপনের মধ্যে যার নিদর্শন বিদ্যমান। কেবল ইউরোপীয় রীতির প্রবর্তন বললে যতটা নিরীহ মনে হবে, ততটা নিরীহ নয়, এ হলো বাঙালির সংস্কৃতির ওপর বিশ্ব পুঁজিবাদের আক্রমণের আরেকটি নিদর্শন। স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আগের চেয়ে অধিক পরিমাণে পরাধীন হওয়া শুরু করে দিয়েছি, ভাবছি আধুনিক হচ্ছি। স্বাধীন বাংলাদেশে আরও একটি উৎপাত এসেছে। ভ্যালেন্টাইনস ডে—বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এটাও বিশ্বায়নওয়ালাদেরই কারসাজি, তারা চায় আমরা আত্মভোলা হই, ভ্যালেন্টাইনস দিনের কার্ড ও উপহারাদি ক্রয় করি। ওই দিবসটি আবার আসে ঠিক একুশের এক সপ্তাহ আগে। কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকলে যেমন সবকিছু তছনছ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও তেমনি আশা রাখে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ম্লান করে দেবে, তরুণদের বলবে তোমরা বিশ্বের দিকে তাকাও, আধুনিক হও।

আধুনিকতার একটি ভিত্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিকতা, দেশপ্রেমের সঙ্গে যার কোনো বিরোধ নেই, বৃক্ষকে সজীব রাখার ক্ষেত্রে যেমন আকাশের সঙ্গে বিরোধ নেই মাটির। আধুনিক হতে হলে আমাদের মাতৃভাষার চর্চা করতে হবে, সেই ভাষার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করতে হবে, নইলে যতই আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করব, ততই পরিণত হব প্রাণহীন যন্ত্রে কিংবা অসামাজিক জন্তুতে। নত হওয়া মানে আর যা-ই হোক আধুনিকতা নয়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ