হোম > ছাপা সংস্করণ

আমরা কোন পথে হাঁটছি!

রেজা ঘটক

করোনা মহামারির দোহাই দিয়ে গত বছরের মতো এ বছরও ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনীতি। ইতিমধ্যে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

১৬ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ লেখক পাঠক প্রকাশক ফোরাম’ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ নিয়ে ১০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। করোনা মহামারি বাস্তবতায় ১০ দফা সুপারিশের একটি ছিল এ রকম—করোনা মহামারি বাস্তবতায় অন্তত ১৫ দিন (৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি) ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে আয়োজন করা হোক।

করোনা মহামারির কারণে গত বছর ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১’ দেড় মাস পিছিয়ে ১৮ মার্চ থেকে শুরু হয়ে নির্ধারিত সময়ের দুই দিন আগে ১২ এপ্রিল শেষ হয়েছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় গত বছর ভিড় এড়াতে স্টলের সামনে ফাঁকা জায়গা রেখে প্রায় ১৫ লাখ বর্গফুটের বিশাল বিস্তৃতি পেয়েছিল বইমেলা প্রাঙ্গণ, যা ছিল ২০২০ সালের প্রায় দ্বিগুণ।

সম্প্রতি করোনাভাইরাসের ওমিক্রন সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের তরফ থেকে বিধিনিষেধ আরোপের কথা বলা হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত বছরের মতো বৃহৎ এলাকা নিয়ে বইমেলা করতে চায় বাংলা একাডেমি। অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক জালাল আহমেদ জানিয়েছিলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকেই বইমেলা শুরুর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’কে সামনে রেখে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্টল তৈরির প্রস্তুতি গত সপ্তাহে পুরোদমে চলছিল। ১৩ জানুয়ারির পর থেকে প্রকাশকদের স্টল ও প্যাভিলিয়ন বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৩ জানুয়ারির পর থেকে বইমেলা প্রাঙ্গণে সব ধরনের কাজকর্ম বন্ধ থাকায় আমরা উদ্বিগ্ন হয়েছি। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা চালু হওয়ার পর থেকে এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

করোনা মহামারির অজুহাত দেখিয়ে গত বছর বাংলা একাডেমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চৈত্র-বৈশাখ মাসে বইমেলা আয়োজন করা যে চরম বোকামি, সেটা প্রকাশক-লেখক-আয়োজকেরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। ছোট-মাঝারি-বড়—সব ধরনের প্রকাশনা সংস্থা গত বছর লোকসান গুনেছে। কিন্তু আয়োজক বাংলা একাডেমির শতভাগ লাভ হয়েছে। আমরা উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, নানান অজুহাতে এ বছরও যদি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ চৈত্র-বৈশাখ মাসে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে দেশের প্রকাশনাশিল্প ধ্বংসের শেষ প্রান্তে চলে যাবে।

ইতিমধ্যে করোনা মহামারির দুই বছরে দেশের প্রকাশনাশিল্পে বড় ধরনের ধস নেমেছে। বইয়ের বাইন্ডাররা ঘর ভাড়া দিতে না পেরে অধিকাংশই গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। ছাপাখানায় এখন প্রচুর ভিড় বাড়লেও বাইন্ডিংখানায় ইতিমধ্যেই বড় ধরনের জ্যাম লেগেছে। প্রথমত, লোকবলসংকট, দ্বিতীয়ত অনেক বাইন্ডার নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারেননি। প্রকাশকেরা লোকসান থেকে বাঁচার জন্য এ বছর যে লাখ লাখ টাকা লগ্নি করে ব্যবসায় নেমেছেন, তাঁরা পুঁজি তুলতে না পারলে এ বছরই দেশের ছোট ও মাঝারি মানের প্রকাশনা সংস্থাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। কেবল অর্থের জোরে বড় কিছু প্রকাশনা সংস্থা হয়তো টিকে যাবে, কিন্তু লোকসান তাদেরও গুনতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী সব সময় চায় বাংলাদেশ পুনরায় অন্ধকার যুগে ফিরে যাক। অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন বন্ধ করার জন্য নানান কিসিমের অজুহাত দেখিয়ে ইতিমধ্যেই তারা নানা ধরনের সফলতা পেয়েছে। বইমেলা প্রাঙ্গণে তারা লেখক অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। বইমেলা থেকে ফেরার সময় লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে তারা কুপিয়ে হত্যা করেছে। লেখক বন্যা আহমেদকে কুপিয়ে আহত করেছে।

জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে তারা কুপিয়ে হত্যা করেছে। লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে এর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল, লেখক রণদীপম বসু ও প্রকৌশলী আবদুর রহমানকে তারা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছে।

আমরা উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, করোনা মহামারির দোহাই দিয়ে অসময়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আয়োজন করলে তা বরং প্রকাশনাশিল্পের বারোটা বাজিয়ে দেবে। উল্টো এই ঘটনায় সুফল পাবে সেই সব মৌলবাদী গোষ্ঠী। যারা দেশের প্রকাশনাশিল্পের ধ্বংস চায়, মুক্তবুদ্ধির চর্চার বিলোপ চায় এবং দেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থেকে যেসব পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে করোনা মহামারির ওমিক্রন সংক্রমণ মার্চ ও এপ্রিল মাসে চরম আকারে বাড়তে পারে। ফলে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার সরকারি কৌশলটি মোটেও কোনো দূরদর্শীমূলক সিদ্ধান্ত নয়।

করোনা মহামারি বাস্তবতায় দেশের অর্থনীতির চাকা চালু রাখার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হচ্ছে। সারা দেশে স্থানীয় পর্যায়ের ভোট উৎসব হচ্ছে। সারা দেশের হাট-বাজার-শপিং মল, পর্যটন স্পট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা। প্রায় দুই বছর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। অথচ করোনা মহামারিতে সারা দেশে মাদ্রাসা খোলা ছিল। ফলে একদিকে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। কিন্তু এর বিপরীতে সারা দেশে যে বাস্তবতা দেখা গেছে সেটি হলো অনেক গরিব বাবা-মা সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করেছেন। বিশেষ করে টিনএজ মেয়েদের গণহারে বিয়ে দিয়েছেন, যা দেশের মিডিয়ায় খুব কম প্রকাশ পেয়েছে।

করোনা মহামারির মধ্যেও সারা দেশে ওয়াজ-মাহফিল চলছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের অটো পাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে তিন বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ে গোল্ডেন ফাইভের বন্যা দিয়ে এসব আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। যে কারণে আমরা আরও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

করোনা মহামারিতে সারা বিশ্ব একসময়ে থমকে গেলেও নতুন বাস্তবতা হলো কোনো দেশ আর লকডাউন দিয়ে অর্থনীতির চাকা বন্ধ রাখতে চাইছে না। বিকল্প পদ্ধতি সবাই বের করছে। ঠিক এ রকম একটি সময়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ পিছিয়ে দিয়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিচর্চাকেই রুদ্ধ করতে চাইছি কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন!

করোনা মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমাদের অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে হবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্ধারিত সময়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ শুরু হলেই বরং প্রকাশনাশিল্পকে বাঁচানোর পাশাপাশি আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হব বলে মনে করি। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ পিছিয়ে দিয়ে কী আমরা সেই সুযোগটি হাতছাড়া করতে যাচ্ছি! সরকার বাহাদুর দয়া করে ভাবুন, ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২’ না হলে কারা সুফল পাবে, সেটিও অনুধাবন করার চেষ্টা করুন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ