হোম > ছাপা সংস্করণ

নতুন নিয়মে প্রকৃতির প্রতিশোধ

মামুনুর রশীদ

একবার জাপানে গিয়েছিলাম এক কর্মশালায়। তিনজন প্রশিক্ষক ছিলাম। একজন সিঙ্গাপুরের নাট্য পরিচালক, অন্যজন মালয়েশিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নাট্যতাত্ত্বিক এবং আমি। সারা দিন প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে কাটে এবং সন্ধ্যায় আমাদের নাটক মঞ্চস্থ হয়।

সময়টা সম্ভবত ১৯৯৩ সাল। মালয়েশিয়ার নাট্যতাত্ত্বিক হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘বলো তো ১০ বছর ধরে তোমরা যে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে, সেই এরশাদ কী করে পাঁচটি আসনে নির্বাচিত হয়ে আসেন?’ প্রশ্নটা করেই তিনি সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বিজ্ঞের মতো আমার দিকে তাকালেন। আমি নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু মনে হলো তিনি আমার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না। সিগারেট নেভাতে নেভাতে বললেন, ‘শর্ট মেমোরি অব দ্য পিপল।’ মানে, জনগণের স্মৃতি খুবই অল্পকালের। ঠোঁটের কোণে একটা মুচকি হাসি। এরপর অনেক রাত পর্যন্ত চলল বাহাস। সত্যটা আমি ততক্ষণে উপলব্ধি করতে পেরেছি।

কয়েক দিন আগে সৈয়দ জামিল আহমেদের ‘বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকটি দেখেছি। নাটক দেখতে দেখতে সেই মালয়েশিয়ার অধ্যাপকের কথা মনে পড়ছিল। তাই তো! কত আগেই আমাদের স্মৃতি থেকে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার নারীদের কথা ভুলে গিয়েছি আমরা। তেমন কোনো দায়বোধও করিনি। কোথায় হারিয়ে গেল তাঁদের আত্মত্যাগের স্মৃতি! এ যেন আমরা ভুলতেই চেয়েছি।

শুধু তা-ই নয়, সেই সব অপরাধী, যারা নারীদের সম্ভ্রম বিকিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে, তাদের কথাও আমরা ভুলে গিয়েছি। যদি সেই সব বীরাঙ্গনা আমাদের আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত হন, তাহলে তো ভুলতেই চেয়েছি, চিনতেও চাইনি। আমরা তাঁদের কথা জানিও না। কীভাবে তাঁরা যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে আত্মীয়স্বজন দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, সব জানার পর স্বামী বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন স্ত্রীকে, বোনকে আশ্রয় দেননি ভাই। এক অজানা অন্ধকারে তাঁরা পা বাড়িয়েছেন, সবই আমাদের জানা। কিন্তু তাঁদের পক্ষে আমরা কি কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছি?

১৯৭২ সাল থেকেই একের পর এক রাজনৈতিক অস্থিরতা, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, সামরিক শাসন এবং এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতি ধ্বংস করে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার এক নিষ্ঠুর চক্রান্ত চলেছে। আবার সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার আন্দোলনও চলেছে। সব আন্দোলনই এ দেশে এক দফা আন্দোলনে পরিণত হয়। তাই জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যাগুলো চাপা পড়ে যায়।এই সুযোগে একাত্তরের ঘাতক দালারেরা রাজনীতির মূলধারায় ঢুকে যায় এবং রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয়ে পড়ে।

বস্তুত এই সময়ে শিক্ষাব্যবস্থায় ধস, নব্য ব্যবসায়ীদের উত্থান, দুর্নীতি—এসব সমাজে বড় জায়গা করে নেয়। পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক শাসনেও এই ধারার খুব পরিবর্তন হয়নি। ফলে ৫১ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধ, বীরাঙ্গনাদের সমস্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শগুলো বিস্মৃতির আড়ালেই ঢুকে যায়। সামরিক শাসনামলে এবং নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের নাটক, টক শো প্রচারিত হলেও দর্শকের কাছে এসব ক্লান্তিকর মনে হয়েছে।

একাত্তর সালে যে শিশুর জন্ম হয়েছে তার বয়স এখন ৫২। তার জ্ঞান হওয়ার পর সে দেখেছে সামরিক শাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের কথা গল্পে পরিণত হয়েছে। সেই শিশু হয়েছে কিশোর, হয়েছে যুবক, এগিয়ে গেছে প্রৌঢ়ত্বের দিকে, কিন্তু নায়ক খুঁজে পায়নি। অসংখ্য নায়ক ছিল একাত্তরে। সেই সব নায়ক কখনো আসেনি তাদের মনোযোগে। বীরাঙ্গনাদের কথা তো গৌণ। সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তো আরও গৌণ। এসব নিয়ে কোনো জোরদার সংলাপও কোথাও গড়ে ওঠে না। একমাত্র আলোচনা গণতন্ত্রও নয়, নির্বাচন। নির্বাচনটা ঠিকঠাক হলেই বোধ হয় গণতন্ত্র এসে যাবে। নানাভাবেই এ দেশে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার গণতন্ত্র কি এসেছে? আমরা কি পেয়েছি সত্যিকার গণতান্ত্রিক একটি দল? ব্যাপক মানুষের উপস্থিতিতে বিশাল বিশাল সমাবেশ কি গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দেয়?

একবারই মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছিল যখন বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে রাজনৈতিক নেতারা ভোটের অধিকার আর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন। তারপর রাজনীতির মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় বড় সমাবেশ। একেবারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাজনৈতিক কর্মীরা কি মানুষকে কিছু বোঝায়? হয়তো তাদের প্রয়োজন হয় না। কর্মীরা যায় না বলেই মানুষ অধিকার সচেতন নয়। বাঁচা-মরার প্রশ্নে, মূল্যস্ফীতির প্রশ্নে কেউ প্রতিবাদ করে না। রাজনীতি হয় শুধু মিডিয়ায়, টক শোতে। মানুষ এখন পত্রিকা পড়ে না, টক শোও ক্লিশে হয়ে গেছে। জীবন্ত থাকছে শুধু সামাজিক মাধ্যম। এই সামাজিক মাধ্যম এতটাই স্বাধীন, যা ইচ্ছে তা-ই কাণ্ড ঘটানো যায়। রুচির দুর্ভিক্ষ শুরু হয় এবং মেধাহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকেরা সস্তা বিনোদনের মাধ্যমে সমাজের কুৎসিত নায়ক হয়ে দাঁড়ায়।

এমনটা শুধু আমাদের দেশেই ঘটছে, তা নয়। খোদ আমেরিকায় সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও পরাজিত হওয়ার পর যে নারকীয় কাণ্ড ঘটালেন, বিশ্বব্যাপী তার নিন্দা হলেও ট্রাম্পের অনুসারীর অভাব নেই। কোথাও কোথাও সব যুক্তিকে অমান্য করে ধর্ম সমাজে একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে। ‘বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটক দেখে বাইরে এসে অসংখ্য মিসডকলের চাপে দর্শক হয়তো সবই ভুলে যাবে। অথবা আমরা আসলে ভুলতেই চাই। একটা অসিলা খুঁজি মাত্র। এই অসিলা খোঁজার লোকের সংখ্যা অনেক বড়।

বড় সুযোগটা এসেছে বাজার অর্থনীতির কারণে। পৃথিবীটা এখন বাজারে সীমাবদ্ধ নয়, বিস্তৃত হয়েছে দোকান। দেশে দেশে আজ গড়ে উঠেছে ব্র্যান্ডের দোকান। মিডিয়ার কল্যাণে সব দেশেই একটা বড় ভোক্তা সমাজ গড়ে উঠেছে। প্রয়োজন না থাকলেও মানুষ পণ্য কেনে।বাড়িতে পণ্য রাখার জায়গা নেই, তবু মানুষ কিনছে। গ্রামেগঞ্জেও এখন ভোক্তা সমাজের সরব উপস্থিতি।

একই সঙ্গে ব্যবসায়ীরা ঢুকে পড়েছেন রাজনীতিতে। তাঁরা ভোট কিনছেন, মন্ত্রিত্ব কিনে নিচ্ছেন, রাষ্ট্রের নব সুযোগ-সুবিধা কিনে নিচ্ছেন। মিডিয়াও কিনছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কিনছেন এবং শিক্ষার্থীদের এই বার্তাও দিচ্ছেন যে দেশে কিচ্ছু হবে না, বিদেশ যাও! অর্থ পাচার করছেন আর তার চেয়ে কয়েক গুণ ক্ষতিকারক মেধাকেও পাচার করছেন। যত বেশি অনুগত, অনুন্নত সংস্কৃতি থাকবে, ততই তাঁদের লাভ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো দুটি জায়গা তাঁরা দখল করে ফেলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষকে তাঁরা সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। মানুষ হয়ে পড়ছে বিস্মৃতিপ্রবণ।

বর্তমান প্রজন্ম তাই ইতিহাস জানতে চায় না, সংস্কৃতি জানাকে সময়ের অপচয় মনে করে। আবার তারাই দেশের আইন রচয়িতার জায়গায় বসে যাচ্ছে। যদিও পৃথিবীটা কোনো ব্যবস্থারই দাস নয়, প্রকৃতিরও একটা শক্তি আছে। তাই কোনো কিছু চিরস্থায়ী নয়। মানুষের সুপ্ত ক্ষোভ, ইতিহাসের বিস্মরণ—এই সব মিলেই একটা নতুন ব্যবস্থার দিকে যাবে—এটাই আমাদের স্বপ্ন।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ