হোম > ছাপা সংস্করণ

ওদেসার সিঁড়ি ও শিশুটির চোখ

মামুনুর রশীদ

রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ দেখতে দেখতে একটি জায়গায় হঠাৎ চোখ আটকে গেল। স্থানটির নাম ওদেসা। কৃষ্ণসাগরের পারে, যেখানে ব্যাটলশিপ পটেমকিনের ঘটনাটি ঘটেছে। সময় ১৯০৫ সাল, নির্বাক ছবির যুগের। ছবির কাজটি হয় ১৯২৫ সালে। ছবিটির নির্মাতা বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সার্গেই আইজেনস্টাইন। পঁচাত্তর মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২১ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন কয়েক হাজার অভিনয়শিল্পী। রাশিয়ার অন্যতম বৃহত্তর বন্দর ওদেসা ছিল ঘটনাস্থল। প্রথমে জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে অফিসারদের খাবার নিয়ে সংঘাতের সূচনা। আবার এ কথাও সত্য, ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় একটি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, যা তখন ব্যর্থ হয়ে যায়। আমরা অবাক বিস্ময়ে ছবিটি দেখতে দেখতে ভাবতাম কী অসাধারণ শিল্পগুণ এই অভিনয়শিল্পীদের, যাঁরা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি, এসেছেন মঞ্চ থেকে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মঞ্চনাটক আরও প্রাচীন এবং ওই সময়ে বড় বড় নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, বিশেষ করে চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা স্তানিসলাভস্কির কাল, চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সার্গেই আইজেনস্টাইন কতগুলো বিষয় সারা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছিলেন—যেমন চলচ্চিত্র সম্পাদনা। একটি ঘটনা দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়ার যে শৈল্পিক উপায়, তা তিনি শিক্ষা দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, একটা বিশাল জনগোষ্ঠী যার প্রাণকেন্দ্র একটি ব্যাটেলশিপ, তাকে চলচ্চিত্রের প্রতিটি মুহূর্ত নির্মাণ করতে কীভাবে সাহায্য করা সম্ভব, এ নিয়ে সারা বিশ্বেই দীর্ঘদিন আলাপ হয়েছে।

চলচ্চিত্রটি ছাড়াও ওদেসার ছবি নিয়ে অনেক কবিতা রচিত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ ওদেসা দেখতে গিয়ে এটিকে একটি পর্যটননগরীতে পরিণত করেছে। রুশ বিপ্লবের পর শুধু যে রুশ বিপ্লবীরা শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র গড়ে তুলতে ঝুঁকে ছিলেন তা নয়, মহৎ শিল্প-সাহিত্যের সংরক্ষণ এবং যেখানে মানুষের প্রতিবাদের ঐতিহ্য আছে, তাকেও বিশ্বের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে তা করেছেন।

সত্তর বছরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু সেই সাফল্য-অর্জনকে ঘুণপোকার মতো কাটতে শুরু করেছে অনেক প্রতি বিপ্লবী। প্রতি বিপ্লবীরা কখনো কখনো বিপ্লবীদেরও আবদ্ধ করেছে। তাই হঠাৎ করে নয়, ধীরে ধীরে একদিন দেখা গেল দেশটা ভাগ হয়ে গেছে। বহু কষ্টে অর্জিত সব সাফল্য একটা ইতিহাসের ভাঙচুরের মধ্যে পড়ে গেল। যে ইউক্রেন আর রাশিয়া একই পতাকাতলে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল ১৯০৫ সালে, সেই দুটি দেশ এখন পরস্পর ভ্রাতৃহত্যায় লিপ্ত রয়েছে। এটার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদেসা বন্দর। যতই বিভক্ত হোক, মানুষ কিন্তু ওদেসার কথা ভুলতে পারবে না, ব্যাটল অব পটেমকিনের কথা ভুলতে পারবে না। লিও তলস্তয়, ম্যাক্সিম গোর্কি, দস্তয়ভস্কি, আন্তন চেখভসহ অসংখ্য কালজয়ী সোভিয়েত লেখক, শিল্পী তাদের কথা ভুলতে পারবে না।

আমরা যারা রুশ বিপ্লবকে মানব ইতিহাসের একটা বড় অধ্যায় বলে বিবেচনা করি, তাদের কাছে এই মার্চ মাসের আকাশে যখন অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যা করছে, তখনই আমাদেরও ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের কথা মনে পড়ে। এভাবে অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করে ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আজ পার্থক্যটা খুবই কষ্টকর, কারণ তখন বাংলাদেশের মানুষ যখন জাগ্রত হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তার পাশে ছিল। একমাত্র বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীর যেখানেই মানুষের মুক্তির যুদ্ধ চলেছে, সেখানেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়, সোভিয়েতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রস্তুত করার বিশাল কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে।

এসবই জানা কথা। এ-ও জানা কথা, শ্রমিকশ্রেণির একটা রাষ্ট্র পুঁজিবাদীরা কোনো দিন সহ্য করতে পারেনি। কত রকম কুৎসা, মিথ্যা সংবাদ রচনা করে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে যে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছিল, তাকেও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মিখাইল গর্বাচেভ, ইয়েলৎসিন শেষ ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। তাদের যৌথ সম্পদ সেটিও ভাগাভাগি হয়েছে কোনো না কোনোভাবে। ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো তাদের মতো করে দেশ পরিচালনা করছে। একটা বড় ধরনের বিভ্রান্তি থেকে যখন নতুন রাষ্ট্রগুলো গড়ে ওঠে, তাতে সমস্যা থাকে বিস্তর। সেই সমস্যা যতটা স্থানিক তার চেয়ে অনেক বড় আন্তর্জাতিক। আর দেশটা যদি সম্পদশালী হয় তাহলে তো কথাই নেই, মানুষ মরছে কিন্তু তার চেয়ে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তেলের মূল্য। আবার কোনো সৎ উদ্দেশ্যে নয়, শুধু রাশিয়াকে কোণঠাসা করার জন্য নানান ধরনের প্রস্তাব ইতিমধ্যেই কার্যকর হয়ে গেছে।

করোনাভাইরাসের আক্রমণের সময় ইউরোপ-আমেরিকা মানুষ বাঁচানোর জন্য কত ধরনের তৎপরতা দেখিয়েছে। কিন্তু এখন রকেট হামলায়, শেলিংয়ে যখন মানুষ মরছে, তখন রাজনীতিটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধের কথা কদাচিৎ টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সাংবাদিকদের মুখে শোনা যাচ্ছে। আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে ইউক্রেন ও রাশিয়ায় যখন কোনো সীমান্ত ছিল না, একটা বিশাল অঞ্চলে যখন একই ভাষায় কথা বলত, নানা আত্মীয়তার সূত্রে মানুষগুলো বাঁধা ছিল, তখন কি কেউ স্বপ্নে দেখেছে এমন এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন আসতে পারে তাদের জীবনে? পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের অনেক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পরিবর্তন হয়নি অন্য দেশ আক্রমণকারী যোদ্ধাদের। সবাই প্রবল হিংসা ও প্রতিহিংসায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কে কার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে এই বিবেচনা বোধটুকুও থাকে না। শুধু নৃশংসতার বিনিময়ে নিজেদের জয়লাভ করা।

পশ্চিমা বিশ্বের একটাই সংকল্প যে পুতিন এবং রাশিয়াকে শায়েস্তা করা। কিন্তু সেই দেশে অসংখ্য নাগরিক আছে, যারা সরকারকে সমর্থন করে না, তারাও পড়ে যাবে এই শায়েস্তার বলিতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার তুলনায় সামরিক শক্তিতে ইউক্রেন যথেষ্টই ক্ষুদ্র। রাজনীতিতে ভুলভ্রান্তি তো আছেই, আর সেই সঙ্গে রাশিয়ারও বিস্তর ভুল রয়েছে। রাষ্ট্রটিকে মাঝে মাঝে ঝলসে উঠতে দেখা যায়। যেমন গত ফুটবল বিশ্বকাপের যে আয়োজন ও শৃঙ্খলা দেখিয়েছিল, তা সত্যিই দৃষ্টান্তস্বরূপ। দেশগুলো কি গণতান্ত্রিক উপায়ে চলার চেষ্টা করছে? নাকি এক ভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় এগিয়ে চলছে?

বেশ কিছুদিন যাবৎ টেলিভিশনে আমাদের দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত থাকে যুদ্ধের সংবাদের দিকে; বিশেষ করে শরণার্থীদের দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ এমনি করে জীবন বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে শরণার্থীশিবিরে জায়গা পেয়েছিল। পার্থক্যটা হচ্ছে ইউরোপের রাস্তাঘাট উন্নত, মানুষের হাতে অর্থ আছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে অনেকেই কপর্দকহীনভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে দিনের পর দিন না খেয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় পেয়েছিল। একদিন এ যুদ্ধের হয়তো অবসান হবে, মানুষ হয়তো ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু তখনকার সমস্যা হবে আরও জটিল, আরও ভিন্ন ধরনের। সেটি সামাল দেবে কে?

ব্যাটলশিপ পটেমকিনে একটি অসাধারণ দৃশ্য ছিল—একটি প্যারাম্বুলেটরে একটি শিশুকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে এক অনিশ্চিত যাত্রায় চলে যাচ্ছে। সেদিনও টেলিভিশনে দেখলাম নিজগৃহ ত্যাগ করে একটি শিশু যখন তার পিতার কাঁধে চড়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তখন বারবার অশ্রু চোখে তার বাড়িটির দিকে তাকাচ্ছে। শিশুটির দুই চোখে অশ্রু কিন্তু ততক্ষণে কাছেই মুহুর্মুহু গোলা পড়ছে। অতএব ওদের ছুটতেই হচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।

বিশ্বটাকে মানুষ কি শরণার্থীশিবির তৈরি করবে? সেই যে শুরু হয়েছে ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লিবিয়ায়। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেই সব মানুষগুলো, যাঁরা জীবন বাজি রেখে ছুটে চলেছেন বাঁচার তাগিদে।

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ