হোম > ছাপা সংস্করণ

পোশাকে পরিবর্তন লক্ষণীয়

স্বপ্না রেজা

একটা গল্প দিয়ে লেখা শুরু করি আজ। আমার বাবা মুহ. আসফ উদ দৌলা রেজা ছিলেন সাংবাদিক মানুষ। দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক ছিলেন একটা সময়ে। তবে চাকরিজীবনের শুরুতে তিনি শিক্ষকতাও করেছেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বাবার ছাত্র ছিলেন। বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলছিলেন সে কথা।

তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছিলেন এবং বলছিলেন, আসফ উদ দৌলা রেজা ছিলেন তাঁর একজন অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক। কেন প্রিয়, সেই ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছিলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তিনি তাঁর শিক্ষকের কথা শুনতেন। মা ও সন্তানের সম্পর্কের মধ্যে যে মধুরতা, তেমনই এক আবেগ-অনুভূতির অবস্থা বিরাজ করত উভয়ের মধ্যে। সুন্দর করে কথা বলার যে অনুপ্রেরণা, তার অনেকটা শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একজন প্রকৃত শিক্ষক বলেই তাঁর স্বীকারোক্তি আকাশের মতো বিশাল এবং জলের মতো স্বচ্ছ।

প্রত্যেক মানুষই যে দেখে ও শুনে শেখে এবং সেই শিক্ষাই যে তাকে জীবন পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করে, প্রেরণা দেয়—এ বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম, নেই বললেই চলে। যদিও ভালো কি মন্দ শিখবে, সেটা নির্ভর করে সে কী দেখছে বা কী শুনছে, তার ওপর। পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিবেশের ভেতরকার উপাদান আরও গুরুত্বপূর্ণ। সোজা কথায়, একজন মানুষের দায়িত্ব হলো আরেকজনকে ভালো কিছু শিখতে উদ্বুদ্ধ করা, ভালো গুণাবলি নিয়ে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা এবং তেমন একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করা।

বাবা সাংবাদিকতার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তাঁর সাধ্যমতো ভূমিকা রেখে গেছেন। বিষয়টি ঘুরেফিরে কমবেশি সবাই বলেন, যাঁরা তাঁকে চেনেন ও জানেন। তিনি একটা সময়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সভাপতিও ছিলেন। সেই সুবাদে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরও তিনি অভিভাবক ছিলেন। সত্তরের দশকের শেষের দিকে একজন তরুণ শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যাওয়ার বিষয়ে বাবার সহায়তা চাইলে বাবা বেশ সাড়া দেন। একপর্যায়ে বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে ছেলেটির হাতে একটি কাগজ তুলে দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। ছেলেটি এল। পরনে টি-শার্ট। সেই টি-শার্টের সামনের অংশে বড় করে লেখা ‘কিস মি’! বাবা হতভম্ব, স্থির! বাবা কাগজ ছিঁড়ে ফেলে ধীর ও শান্ত কণ্ঠে বললেন, তোমার বিদেশে পড়তে যাওয়ার সময় এখনো হয়নি। তোমার বাবাকে বলবে আমাকে ফোন করতে। বাবার মনে সংশয় ছিল, এই ছেলে কীভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে! তার পরিধানের এমন পোশাক একজন শিক্ষক ও সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব মেনে নিতে পারেননি।

পোশাক হলো একটা দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, আচার-রীতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের পরিচায়ক এবং বাহক। পোশাক বলে দেয় কেমন সংস্কৃতিচর্চায় সেই জাতি সক্রিয় এবং আচার-আচরণে ও রীতিতে অভ্যস্ত। বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি—সবকিছুরই প্রতিফলন ঘটে ব্যক্তির পোশাকে। পোশাক দেখে অনুমান করা সম্ভব সে কেমন জীবনপ্রণালিতে অবস্থান করছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেমন, তেমনি বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আচার-রীতি অবাধ চর্চা ও প্রসারের জন্য। আবার একটি দেশকে তার ঐতিহ্যে সংরক্ষিত করে সেই দেশের সংস্কৃতি এবং শুদ্ধ ও সুষ্ঠু অবিরত অনুশীলন। সংস্কৃতি হলো একটি জাতির স্বকীয়তা, নিজস্বতা ও প্রাণশক্তি। একটি দেশের ক্ষতিসাধনের জন্য ভিনদেশি শত্রুরা চেষ্টা করে জাতির এই স্বকীয়তা, নিজস্বতা ও প্রাণশক্তিতে আঘাত করতে। বিশেষ করে তারা টার্গেট করে লক্ষ্যভুক্ত দেশের তরুণসমাজকে। একটি দেশের তরুণসমাজকে বিশ্বাস, ধ্যানধারণায় বিপর্যস্ত করতে পারলেই শত্রুপক্ষের স্বার্থ হাসিল সহজ হয়। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, পোশাক কী করে শত্রুপক্ষের অন্যতম হাতিয়ার হয়? হয়, হয়েছেও। ইতিহাসে দৃষ্টি ফেরালে এবং গবেষণা করলে সেই সত্যের অনুসন্ধান পাওয়া যাবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষার জন্য অনেক নারী তাঁদের বয়স লুকাতে ছোট মেয়েদের পোশাক পরেছে, এই কথা ইতিহাস।আবার পাকিস্তানি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নারীরা বোরকা পরে বাইরে বেরিয়েছেন। বোরকা ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে মুসলিম পরিচয় নির্ধারণের অন্যতম পোশাক। কোনো কারণে যদি তারা জানতে পারত বোরকা পরা নারী হিন্দু বা অন্য ধর্মের, তাহলে সেই নারীর আর রক্ষা ছিল না। তবে এ-ও ঠিক যে হিন্দু নারী কেবল নয়, অজস্র ও অসংখ্য মুসলিম নারীও পাকিস্তানি বর্বরদের কাছে সম্ভ্রম হারিয়েছেন।

বোরকা কাউকে কাউকে রক্ষা করলেও অনেককেই পারেনি। শাড়ি পরা বাঙালি তরুণী পাকিস্তানি হানাদারদের টার্গেট ছিল। শাড়ি পোশাকটি মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। যদি এভাবে বলি—এই শাড়িই বাঙালি জাতির অন্যতম প্রধান পোশাক এবং সংস্কৃতির একটি অন্যতম উপাদান, এ জন্য পাকিস্তানি হানাদারেরা শাড়িকে সহ্য করতে পারেনি, শাড়ি পরা নারীর দেহকে ক্ষতবিক্ষত করেছে—তাহলে কথাটা কতটা অযৌক্তিক বলা হবে? সম্ভবত বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি অনুগত প্রাণের মানুষেরা এমন কথার দ্বিমত পোষণ করবে না বলেই বিশ্বাস।

আবার পোশাকে ফ্যাশন আসে এবং সেটা আধুনিকতা ও বৈচিত্র্যের অজুহাতে। আহারে রুচির পরিবর্তনের মতো পোশাকেও রুচির পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন সাধারণত নকশায়, কাটছাঁটে দেখা যায়। মূল পোশাকের ওপরই এই পরিবর্তন হয়। কিন্তু মূল পোশাক হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা স্বাভাবিক কি না, সে বিষয়ে অনেকের শঙ্কা আছে। অনেকেই অনেক ধরনের পোশাক পরতে পছন্দ করে। এটা তাদের অধিকার। অনেক সময় এই পোশাক পরা নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়েছে, আপত্তিকর ঘটনাও ঘটেছে। তখন বুঝে নিতে হয়েছে যে পোশাকের বিষয়টি কারও কারও কাছে ভিন্ন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে, যা বাংলাদেশের সংবিধানকে সমর্থন করে না।

শাড়ি বাংলাদেশের নারীদের অন্যতম একটি পোশাক। পল্লিবধূ থেকে শুরু করে শহুরে জীবনের আধুনিক নারী শাড়ি পরতেই অভ্যস্ত। কথাটা সম্ভবত এই সময়ে জোর দিয়ে বলা যায় না। গ্রামগঞ্জে, শহরের পথেঘাটে, অফিস-আদালতে যেখানেই দৃষ্টি দেওয়া হোক না কেন, দেখা যাবে হাতে গোনা কজন নারী শাড়ি পরেছে।

অধিকাংশ নারীই বোরকা পরা। কজনার কাছে এমন পোশাক পরার কারণ জানতে চাওয়া হলো। বেশির ভাগ নারী কারণ হিসেবে ধর্মকে হাজির করল। আবার একটা অংশ বলল, পরিবারের পুরুষ সদস্যের চাপে পরা। ছোট একটা অংশ বলল, নিজেদের বাজে দৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য পরা। এই অংশের মাঝে কেউ বলল, এটা একটা ফ্যাশন। বোরকা পরলে আলাদা করে অতিরিক্ত সালোয়ার-কামিজ বানাতে হয় না। যেকোনো কাপড়ের ওপর বোরকা পরে বাইরে বের হওয়া যায়। নিঃসন্দেহে শেষের বক্তব্যটি অর্থনৈতিক সংকটকে ইঙ্গিত করে। একজন রসিকতা করে বলল, কদিন পর আর এ দেশে শাড়ি পরা কোনো নারী দেখা যাবে না। পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনকে যেমন সময়ের মধ্যে বন্দী করে দেওয়া হয়েছে, শাড়ি পরার বিষয়ের ওপরও তেমন বিধিনিষেধ এল বলে। এসব নিয়ে সমাজ-সংস্কারকেরা কিছু ভাবছেন কি? 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ