হোম > ছাপা সংস্করণ

দুর্নীতির বিষয় কি পরলোকের হাতে ছাড়ব?

মামুনুর রশীদ

পৃথিবী বিখ্যাত লেখক লিও তলস্তয় লিখেছিলেন, একজন মানুষের জন্য কতটুকু জমি দরকার? এত জমি মানুষের যে নিজে পায়ে হেঁটে তা প্রদক্ষিণ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, কোনো মানুষের প্রয়োজন তার হাতের মাপের সাড়ে তিন হাত। অথচ মানুষ সাড়ে তিন হাত তো নয়ই, সাড়ে তিন লাখ হাতেও খুশি নয় এবং এই যে অখুশি জনগোষ্ঠী, এরা দরিদ্র নয়, অধিকাংশই উচ্চ শিক্ষিত।

সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া পি কে হালদার ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে গ্র্যাজুয়েট এবং পরবর্তীকালে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চাকরি ছেড়ে ব্যাংকে প্রবেশ করেন। যেহেতু মেধাবী, তাই টাকাপয়সার খোঁজখবর, ফন্দিফিকির কোথায় কী আছে, সেগুলো খুঁজে বের করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়ে যায়। যাঁরা প্রথম থেকেই ব্যাংকে অফিসার হিসেবে চাকরিতে ঢুকছেন, তাঁদের অধিকাংশই এমন একটা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান যে ব্যাংকের টাকা সাধারণত তাঁদের প্রলুব্ধ করে না। পোস্ট অফিসের কর্মচারীরা খুব অল্প টাকা বেতন পান, কিন্তু দায়িত্ব অনেক বড়। পাকিস্তান আমলে যে লোকটি বাইশ টাকা বেতন পেতেন, তাঁর হাতে হাজার হাজার টাকার বিলিবণ্টন হতো। সারা ডাক বিভাগে হয়তো দু-চারটে ঘটনা ঘটত, কিন্তু ডাক বিভাগের সুনাম অক্ষুণ্ন থেকেছে। উন্নত দেশগুলোতে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মার খায়, বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত লুটপাটের কারণে নয়, তার মধ্যে অন্য অনেক কারণ নিহিত থাকে। ব্যাংকে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সামনে অনেক টাকা কিন্তু তাঁরা টাকাকে টাকা মনে করেন না এবং এই টাকা যে তাঁর পকেটে ঢোকানো যাবে না, এই শিক্ষাটা পেয়ে যান প্রথম থেকেই। পি কে হালদারের মতো লোকেরা টাকাকে টাকা মনে করেছেন এবং এই টাকা যে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে সেই টাকা বিদেশে পাঠিয়ে যে পার পাওয়া যাবে, এ ব্যাপারেও নিশ্চিত হয়েছেন। কারণ অতীতে এ রকম পার পাওয়ার অনেক ইতিহাস আছে।

মানি লন্ডারিংয়ের মতো গভীর অসুখে বাংলাদেশ শয্যাশায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকাও ইলেকট্রনিকস সিস্টেমে কেমন করে হাতছাড়া হয়ে গেল! সেই টাকার কিছুটা সন্ধান মেলে ফিলিপাইনের ক্যাসিনোতে। পি কে হালদারও টাকাটি কানাডা হয়ে নির্বিঘ্নে ভারতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভারত বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক। বৈধভাবে ভ্রমণের জন্য আমি কিছু টাকা ভারতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক ব্যাংকার বন্ধুর কাছে গচ্ছিত রেখে চেন্নাই যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার ওই ব্যাংকার বন্ধু কিছুতেই সেই সামান্য টাকাও রাখল না। পথে হারানোর ভয় উপেক্ষা করেই সেই টাকা পকেটে করে আমাকে যেতে হয়েছিল। তাই বলে এ কথা বলব না, পৃথিবীর অন্য দেশে হালদারের মতো লোক নেই। যদি না-ই থাকত তাহলে এত কিছুর ব্যবস্থা কী করে করলেন হালদার? নিশ্চয়ই সেখানে হালদারের সাঙাতের অভাব হয়নি।

বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি, দারিদ্র্য—এসবের কারণ কি জনসংখ্যা? বা দরিদ্র মানুষ? গত ৫০ বছরের পত্রপত্রিকা দেখলে এ কথা নিশ্চিত হই আমরা যে দেশের সম্পদ বিপুল পরিমাণে বিদেশে পাচার হয়েছে এবং তা দরিদ্র, নিম্নবিত্ত মানুষেরা করেনি, করেছে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। যাদের এত অর্থ, টাকাপয়সা হয়ে যায় যে তা নিরাপদে রাখা কঠিন হয়ে যায়। তাই কখনো নির্বিঘ্নে একাকী অথবা কিছু বুদ্ধিমান সাঙাত জুটিয়ে বিদেশে পাচার করে দেওয়া যায়। একটা বড় সুবিধা হয়ে গেছে—শিক্ষা। একটু টাকা হলেই ছেলেমেয়েদের এ দেশে তাঁরা পড়াতে চান না। বিদেশে পড়ানো খুবই ব্যয়সাপেক্ষ, কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। এই কোটি টাকা নেওয়ার পথ একটাই। সেই পথটি হলো অবৈধ, যার জন্য হুন্ডি চালু আছে। নানা ধরনের ফন্দিফিকির আছে, আর এই ফন্দিফিকিরের পথ জানা দেশের সংখ্যাঘনিষ্ঠ মানুষজন লেখাপড়া জানা উচ্চবিত্তরা। শেয়ারবাজারে কয়েকবার ধস নামে, শত শত মানুষ পথে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু যাঁদের পকেটে টাকাগুলো গেল, তারা কি দেশে খাটালেন? দেশে কোথায় লগ্নি করলেন? নাকি খুব দ্রুতই টাকা তার গন্তব্য ঠিক করে ফেলল?

ইদানীং নিয়োগ-বাণিজ্যে যে বিপুল অর্থটি এল তাই-বা গেল কোথায়? বর্তমান সরকার মনে করেছিল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করে দিলেই তাঁরা আর দুর্নীতি করবেন না। কিন্তু দুর্নীতি দ্বিগুণ হয়ে গেল। আমাদের দেশের প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদেরা নানা ধরনের দুর্বোধ্য বিষয় নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেন, কিন্তু এই যে টাকার চলাচল, এসব নিয়ে খুব কমই আলোচনা করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দুর্নীতির যে কনসালট্যান্সি করেন না, এমন কথাও বলা যাবে না। পি কে হালদারের মতো শিক্ষিত মেধাবী লোকেরা দেশে থেকে রাজনীতি করে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবশালী হয়ে পড়েন। তাঁদের জন্য অর্থ পাচারের বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে যায়। দেখা যায়, ঋণখেলাপিদের বড় একটা অংশ বিদেশে ঘরবাড়ি করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ সুখে আছেন। দুর্নীতির অভিযোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁদের বুদ্ধি এবং প্রভাব সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে এখন অবধি আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী তাঁরা দেশের চেয়ে বিদেশে লগ্নি করা, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা বিদেশে করানো নিরাপদ বোধ করেন। কিন্তু এর কোনো আশু সমাধানের কথা আমরা শুনতে পাই না।

বর্তমানে সারা বিশ্বেই টাকা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, আর দুর্বল হয়ে গেছে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, শিক্ষা-সংস্কৃতি এই সব। উপমহাদেশে এসব ক্ষেত্রে ধর্ম একটা জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে মাদ্রাসা শিক্ষার বিদ্যালয়গুলো দুর্নীতির কণ্ঠে নিমজ্জিত। তা আমরা দেখার চেষ্টা করি না। বছরের পর বছর সরকারের কাছ থেকে এরা টাকা পেয়ে যায় কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় বিদ্যালয়টিকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। ফেনীর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কীভাবে অর্থ আত্মসাৎ, হত্যা, ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, বর্তমানে ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারাগারে আছেন, সেখান থেকে সারা দেশের চিত্রটি পাওয়া যায়। পরকালের ভয়ংকর শাস্তিকে তাঁরা ভয় পান না। প্রতিবছর প্রচুর ধর্মপ্রাণ মানুষ হজব্রত পালনে সৌদি আরব যান। বিপুল অর্থের লেনদেন হয়। প্রতিবছরই হজযাত্রীদের অর্থ আত্মসাতের সংবাদ পাওয়া যায় এবং এর সঙ্গেও বিত্তবান ব্যবসায়ীরা যুক্ত থাকেন। বহু বছর ধরেই সরকারের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাস করা খুবই কঠিন বিষয়। লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর মাঝ থেকে মাত্র কয়েক শ উত্তীর্ণ হতে পারেন। তাঁরাই পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। দেখা গেল এসব মেধাবীর কেউ কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ধরা পড়বেন, কিন্তু তাঁদের কোনো শাস্তি হবে না।

বর্তমানে মন্ত্রীরাও একই কাজ করছেন। মুক্তিযোদ্ধা বলে হয়তো কিছুটা ছাড় পাওয়া যায়—এই আশায় তাঁরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিলেন। এটা তো একটা ছোট্ট নৈতিক স্খলন। কিন্তু সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পগুলোর মূল সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে সচিবালয় থেকে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রকল্প বিলম্বিত হচ্ছে, বেশ কিছু অর্থ ব্যয় হওয়ার পর প্রকল্প বাতিল হচ্ছে এবং নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, কিন্তু কোথাও কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার হচ্ছে না। রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতা ছাড়ার পর মামলায় জড়াচ্ছেন, জেল খাটছেন। কিন্তু নেপথ্যের কুশীলবরা বহাল তবিয়তে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং বর্তমানে সাংসদ হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলের নেতার দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছেন। দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচার একটা বড় উপায় রাজনৈতিক আশ্রয়। সেই আশ্রয়ের আশায় প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী আমলা, সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এবং বিপুল অর্থের মালিকেরা দেশের শাসকগোষ্ঠীর অংশ হতে চাইছেন।

দেশের অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু উন্নয়নের একটা বড় অর্থ যে বিদেশে পাচার হচ্ছে, সেদিকে নজর দেওয়ার জন্য যথাযথ সুযোগ্য নজরদারির লোক নেই বললেই চলে। এ কথা সত্য যে পি কে হালদার একা নন। তাঁর মতো আরও অনেক হালদার প্রচুর মেধা, অর্থ ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে প্রতিদিন দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে চলেছেন। দুর্নীতি কি পরলোকের হাতে ছেড়ে দেব? যেহেতু ইহলোকে তাদের বিচার করা যাচ্ছে না!

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ