হোম > ছাপা সংস্করণ

‘নতুন হাওয়া’ লু হাওয়া হবে না তো!

মহিউদ্দিন খান মোহন

বছরের মে-জুন মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশ ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের দক্ষিণাংশের বিস্তীর্ণ মরুময় অঞ্চলে আবহাওয়া প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই সময় সে অঞ্চলে তীব্র গরম বাতাস বইতে থাকে। এই তপ্ত বায়ুপ্রবাহ ‘লু হাওয়া’ নামে পরিচিত। সে সময় তাপমাত্রা উঠে যায় ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। লু হাওয়ার প্রভাবে ওই অঞ্চলের গাছপালা শুকিয়ে যায়, পশুপাখির জীবনও সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। দমকা ও ঝোড়ো হাওয়ারূপে প্রবাহিত লু হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য মানুষ বাইরে বেরোয় না; বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে নিতে হয় বিশেষ সতর্কতা। লু হাওয়ার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। লু হাওয়ার ঝড়কে এ জন্য ওই সব অঞ্চলে ‘কালে আন্ধি’ বা ‘কালো ঝড়’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। লু হাওয়ার প্রভাবে সে সময় মশাসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের উৎপাত বেড়ে যায়। মশার কারণে কখনো কখনো মহামারি আকারে ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া তীব্র গরমে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অনেকে মৃত্যুবরণ করে। এ জন্য ওই অঞ্চলের মানুষ লু হাওয়াকে ‘অভিশপ্ত বাতাস’ বলেও অভিহিত করে থাকে।

হঠাৎ করে লু হাওয়া নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম কেন—এ প্রশ্ন নিশ্চয় সহৃদয় পাঠকদের মনে জেগে থাকবে। কেননা, আমাদের দেশে এখন শীতকাল চলছে। চলছে পৌষ মাস। যদিও তেমন শীত এ বছর এখনো পড়েনি। তবে আবহাওয়াবিদেরা বলেছেন, শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে। সে হিসেবে শীত বা শৈত্যপ্রবাহসংক্রান্ত কথাবার্তাই সময়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো, সন্দেহ নেই।  তো এই সময়ে লু হাওয়া নিয়ে গল্প ফাঁদা বিসদৃশ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আসলে গত ২৬ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকার একটি শিরোনাম পড়েই লু হাওয়া মাথায় ঢুকে বসে আছে। শিরোনামটি ছিল, ‘বিএনপিতে নতুন হাওয়া, বাদ পড়ছেন পুরোনোরা’। মূলত অতিসম্প্রতি কমিটি পুনর্গঠনের নামে বিএনপির কয়েকটি জেলা ও মহানগর কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে ছেঁটে ফেলার বিষয়টি ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। বাদ পড়া নেতাদের মধ্যে রয়েছেন বরিশাল বিএনপির কান্ডারি হিসেবে নেতা-কর্মীদের কাছে খ্যাত বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ার, খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ নজরুল ইসলাম মঞ্জু, রাজশাহী মহানগর বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও বর্তমান সাংসদ হারুন অর রশীদ, বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাংসদ জি এম সিরাজ। এর মধ্যে মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়ার প্রতিবাদ করায় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, উল্লিখিত নেতারা নিজ নিজ এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী ও জনপ্রিয়। বরিশালে রয়েছে মজিবর রহমান সরোয়ারের শক্ত অবস্থান, খুলনায় মঞ্জু কর্মিবান্ধব ও পরিশ্রমী নেতা হিসেবে সুপরিচিত। রাজশাহীতে বুলবুল নেতা-কর্মীদের রাজপথের সাথি হিসেবে কাছের মানুষ। হারুন ও জি এম সিরাজেরও নিজ নিজ এলাকায় রয়েছে শক্ত অবস্থান। ফলে দলের এই দুঃসময়ে তাঁদের দায়িত্ব থেকে বিতাড়ন বিএনপির নেতা-কর্মী, শুভানুধ্যায়ী এবং রাজনীতিসচেতন মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। তাঁদের কথা হলো, যে সময়ে দলকে আরও বেশি সুসংহত করার জন্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, সেই সময়ে এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত দলটিকে আরও হীনবল করে দেবে। 

ইতিমধ্যে বিএনপির হাইকমান্ডের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার খবর এসেছে পত্রপত্রিকায়। খুলনায় মঞ্জু-সমর্থক ৫৬১ জন নেতা-কর্মী গত সপ্তাহে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। নজরুল ইসলাম মঞ্জু একটি দৈনিককে বলেছেন, অসৎ নেতৃত্বের প্রতিবাদেই ওই নেতা-কর্মীরা পদত্যাগ করেছে। তিনি বলেছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে সারা দেশে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সবার মনে একই প্রশ্ন—তাহলে কি ত্যাগী নেতারা সব জায়গা থেকে বাদ পড়ে যাবেন? (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১)।

অন্যদিকে গত ২৮ ডিসেম্বর সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক এসব প্রভাবশালী নেতাকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তে গণহারে পদত্যাগ এবং দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া নেতা-কর্মীদের পাল্লা ভারী হতে পারে। পত্রিকাটি আরও লিখেছে, এর ফলে একদিকে যেমন তৃণমূলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তেমনি তোপের মুখে পড়েছে হাইকমান্ড। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সিনিয়র নেতা পত্রিকাটিকে বলেছেন, ওয়ান-ইলেভেনে সৃষ্ট বিভেদের ক্ষত এখনো দূর হয়নি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরে নতুন যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তাঁরা তাঁকে এই ভয় দেখান যে আবার সে রকম পরিস্থিতি হলে কোনো কোনো নেতা তাঁর সঙ্গে বেইমানি করতে পারেন। তা ছাড়া, কারা কারা তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত মানতে চাইছেন না, তা নিয়েও গবেষণা করছে নতুন ওই সিন্ডিকেটটি। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রভাবশালী নেতাদের শুধু নয়, তাঁদের অনুসারী হিসেবে অনেক যোগ্য নেতাকেও বাদ দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, বিএনপিতে এত দিন স্থানীয় পর্যায়ে যে বলয় সৃষ্টি বা গ্রুপিংয়ের রাজনীতি চলে আসছিল, সম্প্রতি গৃহীত সিদ্ধান্তে তা শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদন পেল। বলা বাহুল্য, দলটি এখন বহুধাবিভক্ত। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দ্বন্দ্ব-কোন্দলে জর্জরিত। এমন কোনো জেলা-উপজেলা নেই, যেখানে দুই বা ততোধিক গ্রুপের অস্তিত্ব নেই। শীর্ষ নেত্রীর কারাবন্দিত্ব এবং তাঁর মুমূর্ষু অবস্থাও তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। এবার স্থানীয় কোন্দলে জড়িয়ে গেলেন শীর্ষ নেতৃত্বও। এটা সর্বজনবিদিত যে বিএনপিতে এখন তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ফলে ওই পাঁচ নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত যে তাঁরই দেওয়া, এটা না বললেও চলে। তবে সচেতন মহলের বক্তব্য হলো, দলের মধ্যে গ্রুপিং-লবিং থাকলেও তা যাতে শীর্ষ নেতৃত্বকে স্পর্শ করতে না পারে, সেভাবেই কাজ করতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম দেখা গেল। স্থানীয় কোন্দলে শীর্ষ নেতৃত্ব একটি পক্ষের পক্ষভুক্ত হলেন। 
প্রভাবশালী নেতাদের এভাবে বাদ দেওয়া বিএনপির জন্য কী ধরনের সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন? জিজ্ঞেস করেছিলাম বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন উচ্চপদস্থ সাবেক আমলাকে। জবাবে তিনি বললেন, ‘সুফল কি হে! বলো কুফলটা কত মারাত্মক হবে।’ তিনি আরও বললেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এ ধরনের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বাঞ্ছনীয় নয়। শীর্ষ নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অনেক ভেবেচিন্তে। কারও দ্বারা প্রভাবিত কিংবা প্ররোচিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তার ফল কখনোই ভালো হতে পারে না। এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে দলে বিদ্রোহের সূচনা হতে পারে। যার লক্ষণ বিএনপিতে এখন অনেকটাই স্পষ্ট।’

 বস্তুত দলে ‘নতুন হাওয়া’ প্রবাহিত করার মানসে যে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়েছেন, তাতে হাওয়া গরম হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এখন যদি সে গরম প্রশমিত করার চেষ্টা করা না হয়, তাহলে অচিরেই তা লু হাওয়ায় পরিণত হয়ে অনেক কিছু ছারখার করে দিতে পারে।

মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ