হোম > ছাপা সংস্করণ

গুদামে আগুন ও টিসিবির কার্যক্রম

হাসান মামুন

বড় ঘটনার সময় একই বা কাছাকাছি ধরনের ছোট দু-একটি ঘটনা কিন্তু ঘটে এবং অবধারিতভাবেই যেন দ্বিতীয় ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যায়। সংবাদপত্রেও সেভাবে আর আসে না, ফলোআপ হয় না। ফলে এমনকি সচেতন মানুষের মধ্যেও সেসব ‘ছোট’ ঘটনা নিয়ে থাকে না আলোচনা। যেমন যেদিন পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে, সেদিনই গভীর রাতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গুদামে আগুন লাগে। টিসিবির গুদাম মানেই খাদ্যগুদাম, নিত্যপণ্যের গুদাম। তাতে আগুন লাগার পর নেভাতে খুব বেশি সময় অবশ্য লাগেনি। ওই সময়ে রাস্তাঘাট ফাঁকা ছিল।

তা ছাড়া ওই দিন ছিল শবে বরাত। আগুন লাগার ঘটনাও ঘটে রাজধানীর কেন্দ্রস্থল তেজগাঁওয়ে। রাস্তাঘাট প্রশস্ত ওখানে। আগুন নেভাতে তাই বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে গুদামে রক্ষিত প্রায় ২০ টন সয়াবিন তেল এবং ১০ টনের মতো ছোলা পুড়ে বিনষ্ট হয়। একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে এ তথ্যটি জানা গেছে। টিসিবির চেয়ারম্যানও ওই পরিমাণ খাদ্যপণ্য বিনষ্ট হওয়ার কথা মিডিয়াকে বলেছেন।

কীভাবে গুদামটিতে আগুন লাগল এবং সত্যিই কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে একটি তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে রমজান মাস সামনে রেখে টিসিবি তার কার্যক্রম নতুনভাবে শুরু করেছে রাজধানীসহ শহরাঞ্চলে। প্রতিষ্ঠানটি ভর্তুকি দিয়ে কম দামে কিছু নিত্যপণ্য নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণের চেষ্টা করে আসছে। টিসিবির সামর্থ্য বেশি নয়। এটা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে অবশ্য এবং সরকারও বলে থাকে, সামর্থ্য বাড়ানো হবে। এটা বলা হয়ে থাকে এ জন্য যে টিসিবি যেসব পণ্যসামগ্রী ট্রাকে করে বা নির্দিষ্ট ডিলারের মাধ্যমে বিক্রি করে, তার পরিমাণ খুব সামান্য। ওই সব পণ্যের মোট চাহিদার ৪-৫ শতাংশ তারা সরবরাহ করতে সক্ষম বলে জানানো হয়। এতে করে দেশের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে বসবাসকারী একশ্রেণির মানুষ কিছুটা উপকৃত হয়; কিন্তু নির্দিষ্টভাবে ওই সব পণ্যের বাজারে তেমন প্রভাব পড়ে না। তবু টিসিবির কার্যক্রমকে আমরা স্বাগত জানাই এবং আশা করি, এটি স্বচ্ছতার সঙ্গে ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে। নানা কারণে দেশে যেহেতু নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক বেড়ে গেছে এবং টিসিবি পণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে, সে জন্য এর কার্যক্রম জোরদারের কথাও আরও বেশি করে বলা হচ্ছে।

এবার রমজানে তিন দফায় ফ্যামিলি কার্ডধারীদের নির্দিষ্ট চার-পাঁচটি পণ্য বাজারের চেয়ে কম দামে সরবরাহ করা হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, তাঁদের পরিকল্পনা ছিল ৫০ লাখ কার্ডধারীর মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সংখ্যাটি দ্বিগুণ করতে, অর্থাৎ এক কোটি কার্ডধারীর মধ্যে ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, খেজুর, ছোলা প্রভৃতি দুই কেজি, এক কেজি করে বিতরণ করতে। রমজান উপলক্ষে সংস্থাটির পণ্যতালিকায় খেজুর ও ছোলা যুক্ত হয়েছে, তবে রাজধানীতে কেবল এ দুটি পণ্য বিক্রি করা হবে। যে দামে এসব পণ্য ফ্যামিলি কার্ডধারীদের মধ্যে দেওয়া হবে, তা দেখা যাচ্ছে বাজারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। যেমন বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১১০ টাকায় দেওয়া হবে, যা খুব আকর্ষণীয়। এ জন্য আবার সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে, যেন টিসিবির এসব ভোগ্যপণ্য, যা জনগণের অর্থে ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে, তা যেন আবার কোনোভাবে সাধারণ বাজারে চলে না যায়। ফ্যামিলি কার্ডধারীদের তালিকা কতটা স্বচ্ছভাবে করা হয়েছে, সে প্রশ্নও আছে। একই ব্যক্তি অনিয়ম করে যেন বারবার আকর্ষণীয় দামে জোগানো এসব পণ্য হস্তগত করতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করা চাই।

সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে টিসিবির উল্লিখিত পণ্যসামগ্রী সংগ্রহ বা কেনার খবরও রয়েছে। যেমন ২৫ হাজার টন চিনি কিনছে সরকার এবং তা দেশি-বিদেশি দুই প্রতিষ্ঠান থেকে। এ খবরও দেওয়া হচ্ছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার যে দামে চিনি কিনছে, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে কিনছে এর অর্ধেকের কম দামে। এটা কেন ও কীভাবে ঘটছে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। দুই উৎস থেকে সংগৃহীত পণ্যের মানে তফাত আছে হয়তো। কিন্তু এতটা তফাত থাকার কথা নয় যে কোনো ক্ষেত্রে দাম অর্ধেকের কম হবে। এসব খবর পড়ে অনেকেরই মনে হতে পারে, টিসিবির কেনাকাটায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। দক্ষতা নিয়েও হয়তো প্রশ্ন উঠবে।

এটাও ঠিক, দেশীয় বাজার তথা দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্যসামগ্রী সংগ্রহ করলে বাংলাদেশি টাকায় সেটা করা যায়। আমদানির ঝক্কিঝামেলা থাকে না। থাকে না অনিশ্চয়তাও। আমদানিতে বড় সমস্যা হলো, এ সময়ে বিদেশি মুদ্রা তথা ডলারের দুষ্প্রাপ্যতা। আমরা বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে আছি এবং সাম্প্রতিক খবর হলো, গত ছয় বছরের মধ্যে এত কম রিজার্ভ কখনো ছিল না। রোজার পর যে ঈদ আসছে, তা ঘিরে দেশে প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স আসা বেড়ে গেলে এবং সরকারি চ্যানেলে বাড়লে রিজার্ভ পরিস্থিতি অবশ্য উন্নত হতে পারে। তবে শর্ত থাকে, এ সময়ে আমদানিও নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে।

টিসিবি যে ভোজ্যতেল জোগাচ্ছে, তার পুরোটাই কি দেশীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা? এই তেল অবশ্য অপরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করেই আনতে হয়েছে আমাদের পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোকে। দেশে চিনির বড় ঘাটতির কথা শোনা গিয়েছিল, বিশেষ করে প্যাকেটজাত চিনি মিলছিল না। এটাও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমদানি করতে হয়। ভোজ্যতেলের পর চিনির দামও বেড়ে গেছে। রমজানের সময় এটা বড় দুঃসংবাদ। কারণ এ সময়ে চিনির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সরকার চিনি আমদানিতে শুল্ক কমানোর মতো পদক্ষেপ নিয়েছে অবশ্য। বাজারে তার সুফল মিলবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন। কারণ টিসিবির কার্যক্রমে তো চিনির বাজারে বড় প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। শুল্ক ছাড়ে প্রভাব পড়লে পড়তে পারে।

যাহোক, লেখাটি শুরু করেছিলাম রাজধানীতে টিসিবির গুদামে আগুন লেগে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পণ্যসামগ্রী বিনষ্ট হওয়ার বেদনাদায়ক খবর দিয়ে। সে প্রসঙ্গে ফিরে যাই। যে পরিমাণ ভোজ্যতেল ও ছোলা ওই ঘটনায় বিনষ্ট হয়েছে, তা দেশীয় কিংবা বিদেশি বাজার থেকে সংগ্রহ করতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগাতে হয়েছিল অর্থ। আর অর্থ মানে বিদেশি ও দেশীয় উভয় ধরনের অর্থ। সরকার কিন্তু উভয় অর্থের সংকটে আছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি খারাপ। সরকারের হাতে প্রত্যাশামতো অর্থকড়ি নেই। সরকার সন্তোষজনকভাবে রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না। তাকে ব্যাংক থেকে অধিক হারে ঋণ করতে হচ্ছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে বলেও খবরে প্রকাশ। জ্বালানি পণ্যের দাম একযোগে অনেক বাড়িয়ে সরকার রাজস্ব আহরণ বাড়াতে চায় এবং প্রতিশ্রুতি থাকলেও এ ক্ষেত্রে দাম কমিয়ে আনতে সম্মত হচ্ছে না; যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম ইতিমধ্যে নিম্নগামী। সরকার আগের মতো বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি জুগিয়ে যেতে পারবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছে।

এ জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তকে দায়ী করে তো লাভ নেই। ভর্তুকি কমাতে সরকারও একপ্রকার বাধ্য। ভালো হতো অপচয়মূলক ব্যয় কমিয়ে সরকার যদি অর্থ সাশ্রয় করতে পারত। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে প্রশ্নবিদ্ধ অতিরিক্ত ব্যয় কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে একটি ছোট ভালো খবর হলো এক কোটি পরিবারে, অর্থাৎ চার-পাঁচ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত চার-পাঁচটি ভোগ্যপণ্য ভর্তুকি দিয়ে টিসিবির মাধ্যমে সরবরাহ করা। আর এরই মধ্যে খারাপ খবর হলো, টিসিবির গুদামে আগুন লেগে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা টনকে টন ভোগ্যপণ্য বিনষ্ট হওয়া। সময়মতো আগুন নেভাতে না পারলে বা ভোজ্যতেলের সংস্পর্শে আগুন ছড়িয়ে পড়ে আরও বড় ধ্বংসলীলা ডেকে আনলে, সেটা অধিকতর বেদনাদায়ক হতো। আমরা চাইব, এ ‘রহস্যজনক’ অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ খুঁজে বের করা হবে এবং যাদের অর্থসম্পদ এতে পুড়ে ছাই হলো, সেই জনগণকে তা জানানো হবে।

টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি দামে চাল জোগানোর পরিকল্পনাও নাকি আছে। খাদ্য অধিদপ্তর ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) মাধ্যমে চাল জুগিয়ে থাকে। এটা আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্য চালের বাজার শান্ত করার একটা কর্মসূচি। এখন টিসিবিও যদি তার নিয়মিত কাজের পাশাপাশি ভর্তুকি দামে চাল জোগায়, তাতে দেশের দরিদ্র জনসাধারণের আপত্তির কোনো কারণ দেখি না। তবে এ নিয়ে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হোক, সেটাও কাম্য নয়।

লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ