১৯৪৮ সালে ওবায়েদ উল হক বাংলা ও হিন্দি ভাষায় ছবি তৈরির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সেই সময় মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে সাম্প্রদায়িক অবস্থার অবনতি ঘটে, পরিবেশ উত্তপ্ত হয়, তাঁর আর ছবি করা হয়ে ওঠে না। তাঁর কাহিনি নিয়ে ১৯৫৯ সালে শুরু হয় ‘আযান’ ছায়াছবির কাজ। তিনি ‘দুই দিগন্ত’ নামের একটি ছবি নির্মাণ করেন ১৯৬২ সালে। তাঁর লেখা কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনায় এই ছায়াছবি নির্মিত হয়েছিল এবং ঢাকার বলাকা সিনেমা হলের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘দুই দিগন্ত’ ছবি দিয়ে।
ওবায়েদ উল হক আমার কাছে বহুমাত্রিক একজন প্রতিভার নাম। অক্টোবরের ১৩ হচ্ছে তাঁর মৃত্যুদিবস। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি তাঁকে।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে আমি আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি এবং যা জেনেছি, তাতে বিস্ময়ভরে ভেবেছি। অবিভক্ত ভারতে সেই সময়ে যখন সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র মুখ তুলে তাকানোর প্রতীক্ষায়, সাংবাদিকতা কিছুটা এগিয়েছে। চলচ্চিত্র তখন এই বাংলায় নতুন, সেই সময়ে ওবায়েদ উল হক আবির্ভূত হয়েছিলেন স্বমহিমায়।
ওবায়েদ উল হক স্মৃতিচারণা করে বলেছেন তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের কথা। দেশভাগের পর চলচ্চিত্রজগৎ থেকে প্রত্যাবাসনের পর তিনি ফেনীর নিজস্ব বাসভবনে বাস করছিলেন। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা এবং পরবর্তীকালে তাঁর চলচ্চিত্রের মুক্তি পাওয়া—এসব নিয়ে কিছুদিন কেটেছে তাঁর। পূর্ব বাংলায় সিনেমা নির্মাণের তখনো সুযোগ তৈরি হয়নি। তাই তিনি লেখালেখি করতেন কিন্তু খুব ব্যস্ত থাকার মতো কিছু ছিল না হাতে, বেকার জীবন কেটেছে বলে তিনি নিজে মনে করতেন। ১৯৫১ সালের ২৫ জানুয়ারি সম্পাদকের অনুরোধে তিনি দ্য পাকিস্তান অবজারভারে লিখতেন। তখন অবজারভারের সম্পাদক ছিলেন আব্দুস সালাম। সম্পাদক ২৫ জুলাই তাঁকে সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দিতে বলেন। জনাব হক বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, ‘সম্পূর্ণভাবে বিস্ময়কর, অভাবনীয় ও অবিশ্বাস্য ঘটনা।’ জনাব হক বলেছিলেন, ‘...এ পেশা সম্বন্ধে অনভিজ্ঞতার কারণে তৎক্ষণাৎ উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু সালাম সাহেব সিরিয়াস। আমার নীরবতায় তিনি নিরুৎসাহিত হননি। ৭ আগস্টে তাঁর একটা টেলিগ্রাম এল, “প্লিজ, জয়েন ইমিডিয়েটলি।” মা তখন বেঁচে ছিলেন, আমার গড়িমসি দেখে বললেন, “ভদ্রতা বলেও একটা কথা আছে, চাকরিতে যোগ দিতে না চাও অন্তত একটা চিঠি লিখে তোমার জানানো উচিত।”’ (শামীমা চৌধুরী, ওবায়েদ উল হক চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক, পৃ. ৬৬)। সাংবাদিকতা পেশায় তাঁর প্রবেশ নিজের ইচ্ছায় হয়নি বলে তিনি বলেছেন, ‘বাই চান্স, নট বাই চয়েস।’ সাংবাদিকতায় তাঁর পথচলা ছিল পেশাদারত্বের সঙ্গে গুরুত্ব মেনে চলা। সেই পথ খুব সহজ ছিল না। অনেক বন্ধুর পথ তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে।
চলচ্চিত্রের সৃজনশীল কাজকর্ম থেকে তাঁকে আসতে হয়েছে দায়িত্বশীল সংবাদপ্রবাহের এক সুকঠিন জগতে। অবজারভারে তিনি সম্পাদকীয়, নিবন্ধ, কলাম ইত্যাদি লিখতেন। অবজারভারের নতুন পথচলা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবসে। বাঙালির জীবনে এই স্বর্ণোজ্জ্বল ও গৌরবের দিনে যখন বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্লোগান দিয়ে বিজয় উল্লাস করছেন, তখন অবজারভার আর প্রকাশিত হবে কি না, এক সংশয় দেখা দিল। জনাব হক স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, ‘এ সময় আমার কর্মস্থল ডেইলি অবজারভার অফিস থেকে বাসায় এলেন সহকারী সম্পাদক (অকালপ্রয়াত)/// নজরুল ইসলাম। বললেন, “স্যার, অফিসে চলেন। অফিসে গন্ডগোল লেগে গেছে।
হামিদুল হক চৌধুরী পালিয়ে পাকিস্তান চলে গেছেন আজই। কাল পত্রিকা বের হবে না।...” তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম পত্রিকা প্রকাশিত হবে নতুন নামে।...বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছে। সেহেতু পত্রিকার নাম আর পাকিস্তান অবজারভার থাকতে পারে না। পাকিস্তান শব্দটি বাদ দিতে হবে।
যে সিদ্ধান্ত সেই কাজ। পত্রিকার প্রধান স্টোরি আমিই লিখলাম। ১৭ই ডিসেম্বর পত্রিকা প্রকাশিত হলো শুধু “দ্য অবজারভার” নাম দিয়ে।’ (শামীমা চৌধুরী, পৃ. ৬৭)। বাঙালি জাতির এই ঐতিহাসিক দিনে তিনি এই মহৎ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছেন। কয়েক দিন এভাবে চলতে থাকার পর পত্রিকাটির নাম হলো দ্য বাংলাদেশ অবজারভার। জনাব নজরুল ইসলাম পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন, আমি তাঁকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক এবং প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ছাত্রপ্রিয় এই ব্যক্তি ওবায়েদ উল হককে শ্রদ্ধা করতেন। ওবায়েদ উল হক বাঙালি জাতির মহান নায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন দিক নিয়ে সিরিজ লিখেছেন। ১৯৭১ সালের পর তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের মহিমা ও বাঙালি জাতির জন্য অসাধারণ অবদানের বিষয়ে লেখা শুরু করেন। ইংরেজি ভাষায় লিখিত তাঁর লেখাগুলো উচ্চমানসম্পন্ন এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে এবং সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রমকে উপস্থাপন করতে সাহায্য করে। সৈয়দ বদরুল আহসান এ বিষয়ে প্রশস্তি করে ডেইলি স্টারে সুদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন।
১৯৭২ সালে ওবায়েদ উল হক বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ অবজারভার ট্রাস্ট পরিচালিত জনপ্রিয় পত্রিকা হিসেবে পরিগণিত ছিল। এই সময়ে ওবায়েদ উল হক পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন যোগ্যতা ও প্রশংসার সঙ্গে। আমরা জানি, আশির দশকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে, কিন্তু এই পরিবর্তনের সঙ্গে জনাব হক আপস করতে পারেননি। পত্রিকার মালিক হামিদুল হক বাংলাদেশে ফিরে এসে কোর্ট থেকে পত্রিকা ফিরে পান।
সেই সময় স্বাধীন মত প্রকাশে বাধাবিপত্তি আসার ফলে ওবায়েদ উল হক পত্রিকা ত্যাগ করে চলে যান এবং আরেকটি নতুন ইংরেজি ডেইলি নিউজের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই পত্রিকাটিতে তিনি ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন। সহজ-সরল ভাষা ব্যবহারের জন্য ওবায়েদ উল হকের সুনাম ছিল। তাঁর লেখায় এবং কথায় হাস্যরসের যে পরিচয় আমরা পাই, তা বিশেষভাবে স্মরণ করার মতো। তিনি অত্যন্ত আশাবাদী মানুষ ছিলেন। গণতন্ত্র এবং রাজনীতির ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যথার্থ। তিনি গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং সংগত কারণেই পরমতসহিষ্ণু ছিলেন। তিনি ভলতেয়ারের একটি উক্তি স্মরণ করে তার মর্মার্থ বলতেন, ‘তোমার কথা আমি মানব না, কিন্তু জীবন দিয়ে হলেও তোমাকে তোমার কথা বলার অধিকার আমি রক্ষা করব।’
ওবায়েদ উল হক ১৯২৮ সালে প্রথম যখন কলকাতা গেলেন, তখন থেকেই তাঁর বিস্ময়ের শুরু বলে উল্লেখ করেছেন নিজের এক লেখায়। দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে যা দেখেন, তা-ই দেখে অবাক হন। ট্রেন থেকে নেমে আলো ঝলমল শহর, টং টং ঘণ্টা বাজানো ট্রাম গাড়িতে চড়ে কলকাতা দেখা অনেক মজার মনে হয়েছে তাঁর। সবচেয়ে বেশি দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় মনে হয়েছে ছায়াছবি দেখে। তিনি রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও আমেরিকার প্রচুর বিনোদনমূলক ও ক্লাসিক্যাল ছবি দেখার সুযোগ গ্রহণ করেছেন। দেখেছেন বিশ্ববরেণ্য অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতার কালজয়ী ছায়াছবি।
এসব স্মৃতিকথার রেশ ধরে তিনি তেতাল্লিশের মন্বন্তরের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন যে ১৯৪৩-এ অনাহারে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। সেই দুর্ভিক্ষ ছিল লোভী মহাজন মজুতদারদের তৈরি কৃত্রিম খাদ্যসংকট। লাশের স্তূপ আর কঙ্কালসদৃশ মানুষের মিছিল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনেক রেখাচিত্রে সেই মানবিক বিপর্যয়ের কথা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। ওবায়েদ উল হক এই বিপর্যয়ের কথা গভীর অনুভূতিতে রেখে ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ চিত্রকাহিনি রচনা করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘আটাশ সালের গোপন সম্পর্ক চুয়াল্লিশে বাস্তব রূপ নিল। কলকাতায় অফিস খুললাম। স্ট্যান্ডার্ড ফিল্মস ও ছায়ানট পিকচার্স নামে পরিবেশন ও প্রযোজনা সংস্থা গঠন করে বেঙ্গল মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়েছিলাম কিন্তু ছবি বানাতে গিয়ে পেলাম অনেক বাধা। সে এক দীর্ঘ কাহিনি। শেষ পর্যন্ত অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ছবি যখন সমাপ্তির পথে, তখন লেগে গেল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা (দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং)।’
এই দুঃসময় কাটিয়ে উঠে ১৯৪৬ সালের ২০ ডিসেম্বর কলকাতাসহ দেশের অনেক ছবিঘরে এবং বিহার, আসাম ও বার্মায় (মিয়ানমার) ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। জানা যায়, ছবিটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। সিনে ম্যাগাজিন রূপমঞ্চের জরিপে সে বছর সেরা ১০টি ছবির একটি নির্বাচিত হয়েছিল। এই ছবি পরে ঢাকার মানসী সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছিল। যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়েও বেশি হয়েছিল, এই ভেবে তিনি নিজের সাফল্যে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ ছবির পরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন সুকুমার দাসগুপ্ত। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই ছবির প্রযোজক, কাহিনিকার জনাব হকের সঙ্গে পরিচালকের মতবিরোধ ঘটে এবং সুকুমার গুপ্ত কাজ শেষ না করেই চলে যান। তখন বাকি কাজ ওবায়েদ উল হক নিজেই শেষ করেছিলেন।
আরও জানা যায়, ১৯৪৮ সালে ওবায়েদ উল হক বাংলা ও হিন্দি ভাষায় ছবি তৈরির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সেই সময় মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে সাম্প্রদায়িক অবস্থার অবনতি ঘটে, পরিবেশ উত্তপ্ত হয়, তাঁর আর ছবি করা হয়ে ওঠে না। তাঁর কাহিনি নিয়ে ১৯৫৯ সালে শুরু হয় ‘আযান’ ছায়াছবির কাজ। তিনি ‘দুই দিগন্ত’ নামের একটি ছবি নির্মাণ করেন ১৯৬২ সালে। তাঁর লেখা কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনায় এই ছায়াছবি নির্মিত হয়েছিল এবং ঢাকার বলাকা সিনেমা হলের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘দুই দিগন্ত’ ছবি দিয়ে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গে তিনি ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটি, সেন্সর বোর্ড, চলচ্চিত্র অনুদান তহবিল এবং চলচ্চিত্র সংসদ চর্চায় বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁর নানাবিধ কাজের অবদান আমাদের নতুন শিক্ষায় আলোকিত করে, আমাদের উজ্জীবিত করে তাঁর আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে। কামনা করি, এই অনন্য সাংবাদিক ও সৃজনশীল চলচ্চিত্রনির্মাতা তাঁর বহুমাত্রিক কাজের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।