‘পড়তে এসেছি, মরতে নয়’, ‘উই ওয়ান্ট সেইফ রোড, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’– গতকাল রোববার সকাল থেকেই এমন স্লোগানে মেতে উঠেছিলেন রাজধানীর শিক্ষার্থীরা। গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের ঘাতকদের দ্রুত বিচার, গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসসহ বিভিন্ন দাবিতে টানা ১৪ দিন চলছে এই আন্দোলন। তবে রোববার আন্দোলনে নামতে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি ও গণ অধিকার পরিষদ।
রোববার সকালে রাজধানীর শান্তিনগর, বাসাবো, উত্তরা, ধানমন্ডি ২৭, কাকরাইলসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টায় ভিকারুননিসা ও সিদ্ধেশ্বরী কলেজের শিক্ষার্থীরা শান্তিনগর মোড়ে অবস্থান নেন। ১২টায় অবস্থানে যোগ দেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাও।
ভিকারুননিসা নূন কলেজের শিক্ষার্থী ফাইযা ফাইরুজ এ সময় বলেন, ‘একটা দেশ হচ্ছে শরীর আর তার মাথা হচ্ছে সরকার। মাথা যদি ঠিক না থাকে তাহলে কোনো কিছুরই সুরাহা হবে না।’ একই কলেজের আরেক শিক্ষার্থী রুবাব সাজদা বলেন, ‘গণপরিবহনে নারী শিক্ষার্থী হেনস্তা, প্রকাশ্যে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই ফলাফল।’
বেলা দেড়টায় শান্তিনগর মোড় থেকে বিক্ষোভ মিছিল করে কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে রাস্তা অবরোধ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রাস্তা ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানান শিক্ষার্থীদের।
কয়েক দিন ধরে সায়েন্স ল্যাব ও ফার্মগেটে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে গেলেও তাঁরা জানিয়েছেন, রোববার সায়েন্স ল্যাব ও ফার্মগেটে পুলিশ তাঁদের বাধা দিয়েছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের (নিসআ) সংগঠক চৌধুরী শামসুজ্জামান বলেন, বেশ কিছু জায়গায় শিক্ষার্থীদের জড়ো হওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ স্থানে পুলিশের বাধার কারণে নামতে পারেননি শিক্ষার্থীরা।
বেলা সাড়ে ১১টায় ফার্মগেটে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিলে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয় বলে জানা যায়। ফার্মগেটে অবরোধে নামতে গেলে তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসানের নেতৃত্বে পুলিশ কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের দাবি বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
এ সময় ছাত্রদের উসকে দেওয়ার অভিযোগে দেওয়ান মোহাম্মদ মূসা নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। বাসাবো থেকে একজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হলেও সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সায়েন্স ল্যাবে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া আরেক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সায়েন্স ল্যাব মোড়ে জড়ো হতে গেলে পুলিশ রাস্তায় নামতে দেয়নি। বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে নিজেরাই বাসে তুলে দিয়েছে।’
দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত ধানমন্ডি ২৭-এ অবস্থান করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, সিটি করপোরেশন, ব্যক্তিগত ও পুলিশের গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করেন তাঁরা। যেসব গাড়িচালকের লাইসেন্স ও গাড়ির বৈধ কাগজপত্র পাওয়া যায়নি, তাঁদের সার্জেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন আইনে মামলা, রেকার ও ডাম্পিং করা হয়।
এদিকে বেলা ১১টায় নটর ডেম কলেজের মুক্তমঞ্চে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের স্মরণসভা করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সভায় নটর ডেম কলেজের প্রধান শিক্ষক ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও বলেন, ‘নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের আবেগ দিয়ে চললে হবে না। গত কয়েক দিনে আরও বেশি করে উপলব্ধি করেছি। সারা দেশ তোমাদের সঙ্গে আছে।’
শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে গতকাল রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার দাবিতে চলা আন্দোলন যৌক্তিক। আমরা শিক্ষার্থীদের এই দাবির সঙ্গে একমত। ভর্তুকি দিয়ে হলেও গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুর।
নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। এতে কিছুটা বিরক্ত হলেও শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। মৌচাক থেকে হাঁটতে হাঁটতে শান্তিনগর মোড়ে আসা গৃহিণী সুস্মিতা খানম বলেন, ‘আমারও দুই মেয়ে আছে। বাসে যাওয়া-আসা করতে গিয়ে প্রায়ই সমস্যায় পড়ে। ড্রাইভার-হেলপারদের আচরণ, লেন মেনে গাড়ি চালানো, ন্যায্য ভাড়া নেওয়া—এগুলো ঠিক করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের এগুলো বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’