শুধু যে নলকূপের পানি পান করে মানুষ আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের ৪৩টি জেলার মানুষ বোরো ধানের চালের ভাত খেয়েও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এই ধানের ভাত শুধু উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষই খাচ্ছে না, খাচ্ছে গোটা দেশের মানুষই, ফলে নীরবে-নিভৃতে ঘাতকব্যাধির প্রসার ঘটছে।
যেহেতু বোরো ধান চাষে প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়, সেহেতু ওই ফসল আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্ত হয়। সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানানোর আগে পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করছি। তাতে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া সম্পর্কে বুঝতে সুবিধা হবে।
বিজ্ঞান বলে, আর্সেনিক একধরনের ধূসর ধাতব পদার্থ। একে সহজে ভেঙে গুঁড়া করা যায়। প্রকৃতিতে সাধারণত দুই প্রকার আর্সেনিক বিদ্যমান—জৈব ও অজৈব আর্সেনিক।
জৈব অপেক্ষা অজৈব আর্সেনিক বেশি ক্ষতিকর। পানিতে প্রধানত অজৈব আর্সেনিক বেশি পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ মাইক্রোগ্রাম। অথচ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন সীমান্ত এলাকার জেলাগুলোয় নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা পেয়েছে ২ থেকে ২.৫ পিপিএম, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। ইতিমধ্যে এর প্রতিফলনও ঘটেছে ব্যাপক হারে; বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় রীতিমতো দুর্যোগ আকার ধারণ করেছে। যদিও দেশের ৬১ জেলায় আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্তের খবর পাওয়া গেছে। তথাপিও উত্তরাঞ্চলের তুলনায় অন্য সব জেলা কিছুটা কম ঝুঁকিতে রয়েছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখন আর্সেনিক-ঝুঁকির সম্মুখীন। এর মধ্যে ২৬৪ উপজেলার মানুষ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। বলে রাখা ভালো, ২৬৪ উপজেলায় আর্সেনিক এক দিনেই আক্রমণ করেনি। এটি ধীরে ধীরে মাটির নিচ দিয়ে ছড়িয়েছে; যা এখনো রীতিমতো ছড়াচ্ছে (উল্লেখ্য, আর্সেনিক মাটির নিচ দিয়ে দ্রুত ছড়াতে সক্ষম), যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ একটু পরেই বলব। তার আগে জেনে নিই গবেষণার আরেকটি ফলাফল।
কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. জিনি পেসোলা তাঁর দলবল নিয়ে আর্সেনিক আক্রান্ত বাংলাদেশের ১২ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাতে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, আর্সেনিকের কারণে অধূমপায়ী ব্যক্তিরাও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, যা এর আগে জানা যায়নি। গবেষক ড. জিনি পেসোলা স্পষ্ট করে বলেন, ‘শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ ধূমপান। কিন্তু অধূমপায়ীরা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান।’ এ ছাড়া আমরা জানতে পেরেছি, আর্সেনিক আক্রান্তের ফলে ক্যানসার সৃষ্টির পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও নিস্তেজ হয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই হাতে-পায়ে ফোসকা এবং আঙুলের মাথায় পচন ধরে। অনেকের বুকে-পিঠে কিংবা জিহ্বা, মাড়িতে ঘায়ের সৃষ্টি হয়, যা পরে মারাত্মক ক্যানসারে রূপ নেয়। অনেকের আবার কিডনি, যকৃৎ বিকল হয়ে পড়ে। সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে এটি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
১৯৮৮ সালে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্য স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ’ প্রথম একটি গবেষণা চালায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়। সেই গবেষণায় আর্সেনিকের অবস্থান নির্ণয় হয় পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত গঙ্গা-ভাগীরথী নদীর পূর্ব প্রান্তে ৭০ থেকে ২০০ ফুট মাটির নিচে। প্রায় ৩৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃতিও ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘গ্রীষ্মকালীন ফসলের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে মাটির কম্পোজিশনে পরিবর্তন ঘটে, ফলে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের দূষণ ঘটে।’
পশ্চিমবঙ্গের কিছু স্থানে আর্সেনিকের সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা পরে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বাংলাদেশে। সেই তথ্য আমরা জানতে পেরেছি বেশ খানিকটা পরে। প্রায় নয় বছর পর ১৯৯৬ সালে প্রথম বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরপর দীর্ঘ ২৫ বছর কেটে গেলেও অদ্যাবধি আর্সেনিকের কবল থেকে মুক্তি পায়নি মানুষ। আর্সেনিকের সমস্যা সমগ্র বিশ্বে কম-বেশি রয়েছে ঠিকই, তবে বাংলাদেশ, ভারতের মতো অত প্রকট আর কোথাও নেই। গবেষক ডা. আনা নাভাস আসিয়ান বলেন, ‘আফ্রিকা ও মেক্সিকোর উত্তরাঞ্চলে আর্সেনিক আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভূগর্ভের আর্সেনিকমুক্ত স্তরে নতুন নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যেতে পারে, তবে এ পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুল।’
আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকেই এখনো জানে না আর্সেনিক আসলে কী? তারা আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হয়ে (বিশেষ করে হাতের তালু, পায়ের তালু কিংবা শরীরে কালচে বাদামি রঙের দাগ নিয়ে) কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে মামুলি চর্মরোগ হয়েছে বলে জেনে আসে। এতে করে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তারা যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অথচ আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে, তাদের মূত্রে ১০০ থেকে ১৮০ শতাংশ বেশি আর্সেনিক রয়েছে। ফলে মৃত্যু অবধারিত। এ থেকে বাঁচার কোনো পথ নেই বলেও দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা আরও একটি ভয়ানক তথ্য জানিয়েছেন, ‘আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নেই বললেই চলে।’ তবে তাঁরা সামান্য আশার আলো দেখিয়েছেন, আক্রান্ত ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে দিলে সেই রোগী স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরে পেতে পারে; যা দেশের দরিদ্র জনসাধারণের জন্য মোটেও সম্ভব নয়।
হতাশাজনক এ সংবাদটি শোনার পর আমাদের করার কিছু নেই মনে করে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। এই মহামারি থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।
জনগণকে নিরাপদ পানি পানে উৎসাহিত করতে হবে; বিশেষ করে উৎসাহিত করতে হবে বৃষ্টির পানি পানে। তার সঙ্গে জানাতে হবে সহজ উপায়ে বৃষ্টির পানি ধারণ ও সংরক্ষণের অত্যাধুনিক কৌশল। জানাতে হবে ভূগর্ভস্থ পানি কম ব্যবহার করে মাটির উপরিভাগের পানি বেশি ব্যবহার করতে হবে। তার সঙ্গে আরও জানাতে হবে, পানযোগ্য পানির উৎসের আশপাশে টয়লেট স্থাপন করা যাবে না। কারণ টয়লেটের বর্জ্যতে মাটির কম্পোজিশন ঘটে, যাতে পানিদূষণ ঘটায় দ্রুত। এর জন্য অবশ্য ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে এনজিও, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকা একান্ত প্রয়োজন।
তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট