‘টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন’। হ্যামলেট নাটকে প্রিন্স হ্যামলেটের এ স্বগতোক্তিটি ৭০০ বছরের অধিক কাল ধরে ভুবনবিখ্যাত হয়ে আছে। এই উক্তির মাধ্যমে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার একটি গূঢ় দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। জীবনযন্ত্রণায় জর্জরিত মানুষের জন্য মৃত্যুই শ্রেয় কি না, উক্তিটির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সেই ভাবনা। তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীব্যাপী এই উক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহার হয়ে এসেছে। আমরাও আজ ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে উক্তিটি ব্যবহার করছি।
আমরা এখন এমন একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখে পড়েছি যেখানে দাঁড়িয়ে ভাবতে হচ্ছে—এক দফা নাকি অন্য (এক) দফা? হ্যামলেটের ভাবনা অনুযায়ী, যন্ত্রণায় জর্জরিত জীবন নাকি মৃত্যুর শীতল স্পর্শ—কোনটি আমাদের জন্য শ্রেয়। রাজনীতির ময়দানে এ এমন এক চূড়ান্ত খেলা যার শেষে রয়েছে পাওয়া কিংবা না-পাওয়া। অর্জন কিংবা বিসর্জন। বেঁচে থাকা কিংবা নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। দেশের রাজনৈতিক শক্তি আজ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে মাঠে নেমেছে। দুই শিবিরেরই আরাধ্য, লক্ষ্য এক দফা। এ এক খেলা বটে। তবে খেলাটা রাজনীতির বলে সব সময় দুইয়ে দুইয়ে চার না-ও হতে পারে। কেননা রাজনীতিতে শেষ কথা বলে আসলেই কিছু নেই। সে জন্যই এক দফা + এক দফার যে সমীকরণ তার ফলাফলের স্থলে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
এত দিনে সবাই জানে যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন শিবিরের এক দফা হলো—সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক ধরনের কোনো সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। দেশব্যাপী সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলে এই দফা কায়েমে তারা বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শিবিরের এক দফা হলো—সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন, যা গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাসম্মত। দেশের সংবিধান অনুযায়ী কোনো অনির্বাচিত সরকারকে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই যে দুই শিবিরের এক দফা + এক দফা, এর ফলাফল কী হবে জাতি আজ সেই প্রশ্নের মুখোমুখি। কারণ দুই শিবিরেরই দফা একটি করে হলেও তা সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর।
বিএনপি এবং তার মিত্রশিবির অবশ্য হঠাৎ করে এক দফার ঘোষণা দেয়নি। অনেক দিন ধরেই তারা সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে ছিল। ২১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব ও নির্বাচনী ব্যবস্থাসংক্রান্ত ১০ দফা দাবি ঘোষণার মধ্য দিয়ে তারা এই আন্দোলন শুরু করে। এরপর দেশের কয়েকটি স্থানে তারুণ্যের সমাবেশ করেছে। এর ধারাবাহিকতায় যে এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা তারা দেবে, সেই আভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল। গত বুধবার ঢাকার সমাবেশ থেকে এই ঘোষণা দেওয়ার আগে তারা রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে সমঝোতা-সমন্বয় আরও পোক্ত করেছে। বলা হচ্ছে এবার তারা প্রস্তুত হয়েই চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য মাঠে নেমেছে।
বছরখানেক ধরে বিএনপি ও তার রাজনৈতিক মিত্র গোষ্ঠী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন চালিয়ে এসেছে তাতে সরকারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সরকার কিংবা সরকারি দল বিএনপির সঙ্গে আলোচনারও কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ফলে বিএনপি নিশ্চিত হয়েছে যে সরকার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কিছুই ভাবছে না। এ বিষয়টিও তাদের বাধ্য করেছে আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ হিসেবে এক দফা ঘোষণা করতে।
অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের নীতিগত অবস্থানের পাশাপাশি রাজনৈতিক ময়দানেও নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে। তারাও সাফ বলে দিয়েছে, তাদেরও দাবি এক দফা। এ থেকে নড়াচড়ার কোনো সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে জনমনে একটি প্রশ্নই বারবার বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে যে কী হবে এই এক দফা যোগ এক দফার চূড়ান্ত ফল? জনগণ কি আবার একটি সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে পড়বে? আবার কি অসহায়ের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি? স্বাধীনতার কয়েক বছর পর থেকে দেশে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও আর্থসামাজিক পশ্চাৎগতির ধারা শুরু হয়েছিল আবার কি সেই ধারা ফিরে আসবে? আমরা জানি না কী হবে। আমরা শুধু আশা করতে পারি ভালো কিছু হওয়ার।
তবে অভিজ্ঞতা থেকে আমরা অনেকেই এ কথা জানি যে এ ধরনের রাজনৈতিক সংকটের সময় উভয় পক্ষেরই যদি কিছুমাত্র নমনীয়তা না থাকে, তবে সংকট গভীরতর হয়। সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেই পরিস্থিতি জনজীবন কিংবা দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি-স্থিতিশীলতা কোনো কিছুর জন্যই ভালো ফল বয়ে আনে না।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক শক্তির দুটি প্রধান শিবির ছাড়া আরও একটি প্রভাবশালী পক্ষ রয়েছে। তাদের আমরা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জানি। আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অবস্থান এখন পর্যন্ত সরকারকে বেশ চাপের মধ্যে রেখেছে। তবে সরকারের দৃশ্যমান ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে সে চাপকে তারা খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। সামলেও উঠতে পারবে। অন্তত সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না।
আমাদের দেশের মতোই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও রয়েছে প্রবল দ্বিধাবিভক্তি। সেখানেও উন্নয়ন সহযোগীদের একাংশ আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পূর্বোক্ত উন্নয়ন সহযোগীদের ভূমিকার সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে, যা সরকারের জন্য কিছুটা স্বস্তিকর হয়েছে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক এই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো বিকল্প হলো দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যমে সংকট উত্তরণ। অবশ্য রাজনীতিতে কখনোই বোধ হয় এমন সহজ-সরলভাবে সমীকরণ মেলে না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক দফা তথা সরকারের পদত্যাগের দাবি ঘোষণা করে গত বুধবারের সমাবেশে বলেছেন, ‘এরপরও যদি আঙুলে ঘি না ওঠে, তাহলে কী করে ওঠাতে হয় এ দেশের মানুষ তা জানে।’ এর মানে হলো, তাঁরা ধারণা করছেন এক দফা ঘোষণা করে ১৮ ও ১৯ তারিখে যে পদযাত্রার কর্মসূচি তাঁরা দিয়েছেন, তাতেই সরকার পদত্যাগ করবে। আর তাঁদের আঙুলে ঘি উঠবে। যদি তা না হয় তাহলে আঙুলে ঘি ওঠানোর, মানে সরকারের পদত্যাগের আরও কর্মসূচি তাঁরা দেবেন। এখানেই বিএনপি এবং মিত্র গোষ্ঠীর সক্ষমতার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য যে মাত্রার আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার তা তাদের কতটা রয়েছে? বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যখন আওয়ামী লীগ। তারাও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক দফা ঘোষণা করে রাজপথে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে এবং রাজপথেই আছে।
সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বিএনপির সহযোগী শক্তির মধ্যে প্রধান হচ্ছে তাদের মিত্র ইসলামি দলগুলো। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী এখন তাদের সঙ্গে আগের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা নেই। আবার নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না পাওয়ায় ভোটের মাঠেও তাদের অংশগ্রহণ করা হবে না। সে ক্ষেত্রে আন্দোলন এবং নির্বাচন উভয় ক্ষেত্রেই জামায়াতের ভূমিকা বিএনপির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। যদিও জামায়াত বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।
আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির ভূমিকা। এই সবকিছুর চুলচেরা হিসাব-নিকেশের মাধ্যমেই বের হবে এক দফা + এক দফার প্রকৃত ফলাফল। সেই ফলাফলের ওপরই নির্ভর করবে আগামী দিনে দেশ ও জনগণের ভাগ্য।
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক