প্রায় আড়াই যুগ ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞান বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। এসব অভিজ্ঞতায় বিজ্ঞানের কৌতূহল শুধু কিশোর-তরুণদের মধ্যে নয়, সব ধরনের মানুষের মধ্যেই দেখেছি। বিজ্ঞানের বিষয়ে তাঁদের প্রবল আগ্রহ, বিজ্ঞানের চর্চা ও বিজ্ঞান আলোচনায় তাঁরা আনন্দ পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, তাঁরা তাঁদের শিক্ষাজীবনে এই আগ্রহটুকু ধরে রাখতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা চেয়েছেন এর মধ্য দিয়ে পথ চলতে।
কেন এ রকম হচ্ছে, তা নিজের মধ্যেও বহুবার প্রশ্ন জেগেছে। কিছু উত্তরও পেয়েছি। যেমন বিজ্ঞান শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনগুলো এমন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি করে না। ফলে যাঁদের মধ্যে কৌতূহল আছে, তাঁরা নীরবে ঝরে পড়েন। দ্বিতীয় কারণ হলো, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ দেশে চাকরির সুযোগ অনেক কম। ফলে অনেকেই এসব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে উৎসাহবোধ করেন না। পরবর্তী সময়ে এই মনোভাবটি তাঁদের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রবাহিত হয়। তাঁরা মনে করেন, কসমোলজি, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্ব, রবার্ট পেনরোজ, স্টিফেন হকিংয়ের কথা শুনে উল্লসিত বোধ করবে; কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় যাবে না।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা এমন যে কোনো শিক্ষার্থীই তাঁর পছন্দের বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রে পড়ার সুযোগ পান না। এরপরও বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহীদের মধ্যে অল্পসংখ্যক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ পায় মাত্র। বিজ্ঞানের প্রতি কোনো আগ্রহ আসলে এখানে কাজ করে না। যাঁরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান, তাঁদের মধ্যে আগে থেকে মানসিক কোনো প্রস্তুতি থাকে না। এরপর কখনো কখনো পড়তে পড়তে কোনো বিষয় ভালো লেগে যায়। শিক্ষার্থীরা মজা পেয়ে যান, কৌতূহলী হয়ে ওঠেন।
কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার প্রক্রিয়াটা এমন, সেই মজাটা তুলে আনা কঠিন ব্যাপার। এ ব্যাপারে দ্বিজেন শর্মা একবার বলেছিলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের অনেক বিষয় আছে। কিন্তু এর সঙ্গে একটি বিষয় ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক বিজ্ঞান শিক্ষার্থীকে পড়তে হয়। বিজ্ঞানের ইতিহাস হচ্ছে, প্রতিটি আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের পেছনের যে সুখ-দুঃখ ও সামাজিক কার্যকারণ বিরাজমান থাকে, এর বর্ণনা এবং বিশ্লেষণকে তুলে ধরা। তখন একজন বিজ্ঞানশিক্ষার্থী বুঝতে পারেন এই আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, আমাদের মতোই তাঁদের হাসি-কান্নার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পার্থক্য শুধু অভিজ্ঞতাকে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা। তিনি তখন বিজ্ঞানের প্রতি নৈকট্য অনুভব করেন। তখন জায়গাটি তাঁর কাছে খটখটে বিষয় থাকে না, নিজেকে উন্মোচনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে লেখক ও প্রকাশক মফিদুল হক এবং সাংবাদিক ও লেখক আবুল মোমেনের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, তাঁরাও একই রকম মত ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞানের ইতিহাসের ওপর কোনো বিষয় নেই। এ ব্যাপারে কিছু বললে সংশ্লিষ্ট মানুষেরা বলেন—বিজ্ঞানই ঠিকমতো পড়ানো হয় না, আবার এর মধ্যে বিজ্ঞানের ইতিহাস! ফলে আমাদের দেশে বিজ্ঞান কতগুলো তত্ত্ব মুখস্থ করা অথবা যন্ত্র উদ্ভাবন ছাড়া আর কিছুই নয়। একেবারেই একটি নিরেট টেকনিক্যাল বিষয় হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। ফলে চাকরি পাওয়ার হাতিয়ার ছাড়া আর কোনোভাবে এটাকে শিক্ষার্থীরা বিবেচনা করেন না। ফলে এর প্রতি না থাকে আগ্রহ, না থাকে ভালোবাসা। অথচ শিক্ষার মূল কাজ হচ্ছে সেই ভালোবাসা, সেই আবেগ-অনুভূতি জাগিয়ে তোলা। সেই মানবিক বোধগুলোর বিকাশ ঘটানো, যার দ্বারা সমাজের অন্য আর দশজনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, তাঁকে সৃজনশীলভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করানো যাতে নিজের জায়গাটি খুঁজে নিতে পারেন। চিন্তা দিয়ে, কাজ দিয়ে সমাজে অবদান রাখতে পারেন। এ কাজটি ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে, শিক্ষাকে আমরা ভালো চাকরির অস্ত্র হিসেবে দেখেছি। স্কোরের প্রবণতা নিয়ে কোনো রকম বোঝাপড়া ছাড়া একজন শিক্ষার্থীর একের পর এক ক্লাস টপকানো কোনো মানবিক বোধ তৈরিতে সামর্থ্য হয় না। ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ না পড়ার কারণে জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে হয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের মারাত্মক অনীহা
সৃষ্টি হয়।
সৌভাগ্যবশত আমাদের দেশে সবার নাগালের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই রচিত ও অনূদিত হয়েছে। যেমন—বিজ্ঞানের ইতিহাস (জর্জ সার্টন), ইতিহাসে বিজ্ঞান (জে ডি বার্নাল), বিজ্ঞানের ইতিহাস (সমরেন্দ্রনাথ সেন), প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান (মোহাম্মদ আবদুল জব্বার)। বার্নালের বইটি অবলম্বনে সংগ্রামী লেখক সত্যেন সেন সেই ষাটের দশকে একটা সংক্ষিপ্ত সংস্করণ ‘বিজ্ঞান ও ইতিহাস’ রচনা করেছিলেন। পাঠ্যক্রমে ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ যুক্ত হলে আরও ভালো ভালো বই লেখা এবং অনুবাদ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পরিসংখ্যান বলছে, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, প্রায় পাঁচ গুণ এবং উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় দ্বিগুণ হারে এই বৃদ্ধি হয়েছে। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আলী আসগর বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার পেছনে চাকরির সীমিত সুযোগকে দায়ী করেছেন। আরও দায়ী করেছেন ভালো শিক্ষকের অভাবকে, যাঁরা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন, সমাজকে আশান্বিত করতে পারেন এবং বিজ্ঞান পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে পারেন। কিন্তু এ-ও সত্য, একজন ভালো শিক্ষকের গড়ে ওঠার পেছনে সামাজিক মূল্যায়নও হতাশাব্যঞ্জক। আর আমাদের সংস্কৃতিতে রয়েছে বিজ্ঞানকে গ্রহণ না করার প্রবণতা। বিদেশি জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের আকর্ষণ নেই, রয়েছে বিদেশি অর্থের প্রতি লোভ। তখন ধনী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে এ ধরনের মানুষদের দিয়ে গরিব দেশগুলোর ওপর তাদের উদ্দেশ্যকে চাপিয়ে দেয়। টেক্সট বইয়ের উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়; কিন্তু বিদেশিদের অর্থ দেওয়ার কারণে তাদের হস্তক্ষেপ নানাভাবে হয়, যা বন্ধ করা যায় না।
সবকিছু থেকে এটা পরিষ্কার যে বিজ্ঞানের সৃষ্ট প্রযুক্তিকে ব্যবহারে প্রবণতার বৃদ্ধি ছাড়া বিজ্ঞানের প্রতি আমাদের কৌতূহল ক্রমেই কমছে। বিজ্ঞানকে সবকিছু করে দেওয়া জাদুর যন্ত্র হিসেবেই সবাই দেখছে, যা ভোজবাজি ঘটিয়ে কিছু একটা করে দেবে। অথচ বিজ্ঞান হচ্ছে যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তৈরি একটি প্রক্রিয়া। ফলে বৈজ্ঞানিক মানসিকতার বিকাশ ঘটছে না। একজন শিক্ষার্থীর সামনে বিজ্ঞানের সত্য এবং ধর্মের বিশ্বাসকে শিক্ষার প্রারম্ভে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে এ দুটি বিষয় তার কাছে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু এ দুটির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি বিশ্বাস স্থাপন, আরেকটি হলো যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়। আবার শিক্ষার্থীকে চার্লস ডারউইন ও রাসেল ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচন পড়ানোর সময় বলা হয় ‘বিশ্বাস করো না’। তখন কিশোর মনে একধরনের বিভ্রাট তৈরি হয়। শিক্ষার্থীর মনে যৌক্তিকবোধগুলোর বিকাশ ঘটতে পারে না। এই প্রতি বিপরীত পরিস্থিতিগুলোও একধরনের অনীহা তৈরি করেছে।
এই প্রতি বিপরীত বিষয়গুলো থেকে বের হতে না পারলে আমাদের সমাজে বিজ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটবে না। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষেধক হতে পারে ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ পড়ানো। যাতে বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি তত্ত্ব উপস্থাপন করার সময় তার পেছনের ইতিহাসটা তুলে ধরতে পারলে বিষয়টা শুধু বোঝাই সম্ভব হয় তা নয়, একধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি ঘটে। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান হচ্ছে মহাবিশ্বকে বোঝা, মহাবিশ্বের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক অনুধাবন করা। বিজ্ঞানের ইতিহাস হচ্ছে সেই অনুধাবনকে সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া। নিজের দেশের পলিমাটির সঙ্গে বিজ্ঞানকে আত্তীকরণ করে না দেখতে পারলে বিজ্ঞানের বিশ্বজনীন ব্যাপারকে অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। এ জন্যই অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১০০ বছর আগে ‘বিশ্বপরিচয়’ নামের কসমোলজির একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত