১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের পত্রিকাগুলো নাড়াচাড়া করছিলাম। একটি নতুন দেশের জন্ম-পূর্বক্ষণের যে আভাস তাতে পাওয়া যাচ্ছিল এবং জন্ম-পরবর্তী সময়ের যে আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য রচিত হয়েছিল তাতে, তা এখন শুধুই ইতিহাস। অর্ধশতাব্দী আগের সেই অনুভূতির চাঞ্চল্য এ সময়কার মানুষ অনুভব করতে পারবে না এবং এ কথাও সত্যি, আর কিছুটা সময় অতিক্রান্ত হলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউই বেঁচে থাকবেন না। এ এক অমোঘ বেদনাময় সত্য।
আমাদের সৌভাগ্য, আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। আমরা বিজয় দেখেছি। আমরা একটি ঐতিহাসিক সংগ্রামের পরিণতি দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিবাচক দিক এটাই। যে দেশ গড়ে তোলার জন্য সংগ্রাম হয়েছিল, যে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন হলো না কেন, সে তো ভিন্ন প্রশ্ন। সে প্রশ্নের জবাবও আমাদেরই দিতে হবে। কিন্তু প্রবল বীরত্ব প্রদর্শন করে ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার যে অনন্য দৃষ্টান্ত আমরা স্থাপন করেছিলাম, তা নিয়ে গৌরব করার মধ্যে কোনো গ্লানি নেই। মনে রাখতে হবে, এই উপমহাদেশের অন্য দুটো দেশ—ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল দেশভাগের ফল হিসেবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। ফলে, শোষণমুক্ত দেশ গড়ে তোলার একটি বৃহৎ অঙ্গীকার বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসেই ছিল এবং সংগ্রামের পরিণতিতে সেই স্বপ্নের দেশটিই ছিল আরাধ্য, সে কথা স্বীকার করতেই হয়।
১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনার কথা এখনো মনে আছে। তা থেকেই একটি বলছি। যুদ্ধের সময় হঠাৎ করেই দুই পাকিস্তানি মিলিশিয়া টহল দিতে দিতেই আমাদের চামেলীবাগের বাড়িতে এসেছিল। (এই বাড়ি থেকেই ১০ ডিসেম্বর আমার বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও আলবদরের দল। তিনি আর ফিরে আসেননি।) পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল তাদের, কিন্তু আমাদের হাতে পানি তারা খাবে না। দেখিয়ে দিল নারকেলগাছ। সেই নারকেলগাছ থেকে ডাব পেড়ে আনা হলো। গ্লাসে করে সেই ডাবের পানি তাদের দেওয়া হলেও তারা শুরুতে খায়নি। অন্য গ্লাসে আমাদের ছোটদের আগে খেতে বলল। আমরা খাওয়ার পর যখন বুঝল, এই ডাবের পানিতে বিষ মেশানো নেই, শুধু তখনই তারা ডাবের পানি খেল।
কথাটা বলা হলো এ কারণে যে বাঙালি তথা এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী কাউকেই বিশ্বাস করত না পশ্চিম পাকিস্তানিরা। একই দেশের দুটি অংশ হলেও পূর্ববঙ্গের প্রতি যে অবজ্ঞা, অবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনে এবং তারা যে উচ্চমন্যতায় ভুগত, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। সে সময়ের শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস কোনো রূপকথার গল্প নয়। পাকিস্তানি জেনারেলরা একাত্তরে যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, তারা পূর্ববাংলার মানুষকে ‘আশরাফ’ মুসলমান বলে মনে করত না। বাংলার মুসলমানরা কেন ‘আতরাফ’ ছিল, তার কারণ হিসেবে বলত, এখানে শিক্ষকদের অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। হিন্দু সংস্কৃতি ঢুকে গেছে বাংলার মানুষের মজ্জায়। তাই বাংলার মানুষদের ‘সাচ্চা মুসলমান’ বলে অভিহিত করা যাবে না। ধর্মের নামে উন্মাদ হওয়া পাকিস্তানি সেনারা তাই এ দেশে নির্দ্বিধায় জেনোসাইড ঘটাতে পেরেছিল। তারা মানুষকে মানুষ বলেই গ্রাহ্য করেনি।
দুই
১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি পোস্টার ছাপানো হয়েছিল, ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ ছিল তার শিরোনাম। সেখানে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, তা তুলে ধরা হয়েছিল। কেউ একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, সে সময় বৈদেশিক সাহায্যের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির শতকরা ৯০ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। উন্নয়ন খাতে পশ্চিম পাকিস্তানে ৬ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে খরচ করা হতো ৩ হাজার কোটি টাকা। বাংলায় চালের দাম ছিল মণ ৫০ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ২৫ টাকা।
একই দেশ, কিন্তু বৈষম্যের এই চিত্র মানুষকে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। সত্তরের নির্বাচনে ছয় দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ম্যান্ডেট পেলেন, তাতেই স্পষ্ট হলো, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবেই আওয়ামী লীগ নেতা সংসদে যাবেন।
কিন্তু তার পরের ইতিহাস সবার জানা। শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতায় বসতে দেওয়া হবে না, এই ষড়যন্ত্রই চলল। ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোর। এর আগে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে এবং সেটাই আসলে আইয়ুব খানকে নিয়ে গিয়েছিল পতনের দ্বারপ্রান্তে। যে দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে আইয়ুব খান এসেছিলেন ক্ষমতায়, যেভাবে রাজনীতিকে তিনি নিজের বশংবদ বানানোর চেষ্টা করেছেন, তা ছিন্ন করেই এগিয়েছে আন্দোলন এবং ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সাল দুটি মাইলফলকের মতো নতুন সময়ের নতুন দিকনির্দেশনা হিসেবে হাজির হয়েছিল। ফলস্বরূপ ইয়াহিয়া ক্ষমতায়, নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের বিজয়।
তিন
পাকিস্তানিরা চেয়েছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি দিয়ে বশ করবে আন্দোলন। লাশ পড়লেই দমে যাবে মানুষ। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল সেই জেনোসাইড। রাও ফরমান আলী, খাদিম হুসেন রাজারা মিলে যে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, তাতে মানবতার কোনো পরিচয়ই ছিল না। যেকোনোভাবে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। পোড়ামাটি নীতিতে এগিয়েছিল পাকিস্তান।
আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে একটি যুদ্ধ নেমে এসেছিল। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে পাকিস্তান টিকে থাকত কি না, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বৈষম্য দূর করতে পারতেন কি না, পূর্ব বাংলার মানুষদের দিয়ে আমলাতন্ত্র, সেনা নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা যেত কি না, আরও রাজনৈতিক পরিপক্বতা আসত কি না, সে বিষয়ে কল্পনা করে লাভ নেই। কিন্তু সত্যিই প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গার নেতৃত্ব নিতে গিয়ে অভিজ্ঞতার ঘাটতি যে আমাদের ভুগিয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর সে কারণেই কি দেশপ্রেমের অভাবও পরিলক্ষিত হয়েছে দেশ গঠন করার সময় এবং পরবর্তীকালে? নইলে বিভিন্ন সময়ে দেশের সম্পত্তি এভাবে মেরে-কেটে হাপিস করে দেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হলো কী করে?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে হবে। আর সেই জবাব খুঁজতে গেলে হাঁটতে হবে খুবই সূক্ষ্ম পথ ধরে। আমাদের ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে আমরা যদি গোটা স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা, মুক্তি সংগ্রামকেই খাটো করে ফেলি, তাহলেই ভুল পথে হাঁটা হবে। সেটা হবে আত্মঘাতী প্রয়াস। স্বাধিকার আন্দোলনকে খাটো করার অর্থই হচ্ছে আমাদের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। শত্রুপক্ষ সেই সুযোগের অপেক্ষায়ই আছে। তারা বলতে চাইছে, দেশ স্বাধীন করে কী লাভ হলো? ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম...’।
তারা আসলে মিথ্যে বলে। আগে সুন্দর দিন কাটানোর সুযোগ ছিল না। বারবার পাকিস্তানিদের ঘৃণা ও শোষণের শিকার হয়েছি আমরা। ব্রিটিশ বাহিনী যেভাবে আমাদের শোষণ করেছে, পাকিস্তান সে রকমই কঠোরতা দিয়ে দমন করেছে আন্দোলন। সুতরাং পাকিস্তানের পক্ষে মায়াকান্না করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।
কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। আমরা নিজের দেশ নিজেদের হাতে পেয়ে কেন সে দেশটির কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারছি না? সুশাসন, গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা, ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহির প্রকাশ কি খুবই জটিল বিষয়? কেন আমাদের রাজনীতিবিদেরা জনগণের সেবক হবেন না, আমলাতন্ত্র কেন নিজেদের দেশের রাজা বলে মনে করবে, ব্যাংকের পর ব্যাংক লোপাট হবে কেন, রাজনীতি আর সংস্কৃতির দূরত্ব বাড়তে বাড়তে তাদের মধ্যে সম্পর্কই-বা কেন শেষ হয়ে যাবে?
বুঝতে হবে, দায়টা আমাদেরই। যাঁরা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, যাঁরা স্বাধিকার আন্দোলন করেছিলেন, যাঁরা একটি মুক্ত স্বদেশভূমি চেয়েছিলেন, দায়টা তাঁদের নয়। তাঁরা তাঁদের আরাধ্য কাজ করে দিয়েছেন। বাকিটা করার কথা ছিল স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকেরা তাদের সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছে কি না, সেটা তো সাদা চোখেই দেখা যায়।
নানা রকম উন্নয়ন হয়েছে দেশের। অর্থনীতির বহু ক্ষেত্রেই আমাদের শক্তিমান উপস্থিতি। কিন্তু আদতে সামগ্রিকভাবে আমরা কি জবাবদিহিমূলক একটা রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পেরেছি? না, পারিনি। আর তাই, একধরনের হতাশা থেকেই মৌলবাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ বাড়ছে কি না, সে প্রশ্নটি নিয়েও ভাবতে হবে। দুই যুগ আগেও ধর্মব্যবসা নিয়ে কঠোরভাবে যেভাবে কথা বলা যেত, এখন কেন তা যায় না—সে প্রশ্ন তো নিজেদেরই করতে হবে। যে অঙ্গীকার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেই অঙ্গীকার পালনের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। দলাদলি, হিংসা, দুর্নীতি, পেশিশক্তি, জবাবদিহিহীন সমাজ শুধু অর্জনগুলোকে নষ্ট করে দিতে থাকে, গঠনমূলক স্বস্তির নিশ্বাস নিতে দেয় না। অথচ সেই স্বস্তিরই প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি।
অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এখন এমন অনেক প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের। অন্যের ওপর দায় না চাপিয়ে নিজেদের ভুল-ভ্রান্তিগুলোর দিকেই রাখতে হবে চোখ।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা