হোম > ছাপা সংস্করণ

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট: দায় কার?

ড. মইনুল ইসলাম

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির তাণ্ডব সাধারণ জনগণের জীবনকে বিপর্যস্ত করছে। ৫ আগস্ট ডিজেল ও অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম এক লাফে ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়ে সরকার অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিকে অনিবার্য করে তুলেছে। পেট্রলজাত পণ্যের এই অভূতপূর্ব মাত্রার মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও এলএনজির দামের প্রবল স্ফীতিকে যুক্তি হিসেবে খাড়া করলেও আমরা দেখাতে চাই যে সরকারের নিজেদের গাফিলতিতেই অর্থনীতিতে বর্তমান বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এই বক্তব্যের সমর্থনেই বক্ষ্যমাণ কলামটি লিখছি।

 গত বছরের জুলাই থেকে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেলাগাম বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের জুন মাসের শেষে এসে ২০২১-২২ অর্থবছরের মোট আমদানি ব্যয়কে ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১ বছরে ২০২১-২২ অর্থবছরের আমদানি ব্যয় ছিল সর্বোচ্চ। ফলে দেশের রপ্তানি আয় ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া সত্ত্বেও একই অর্থবছরের বাণিজ্য-ঘাটতি ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ বরাবরই একটা বাণিজ্য-ঘাটতির দেশ। সাম্প্রতিক দুই দশক ধরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্স এই বাণিজ্য-ঘাটতি মেটানোর জন্য যথেষ্ট হওয়ায় দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে তিন-চার বছর বাদে প্রতিবছর উদ্বৃত্ত হওয়াই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। ফলে ২০০১-০২ অর্থবছর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে মাত্র ১ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারে অবনমিত হয়েছিল, সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। এর পর থেকে শুরু হলো রিজার্ভের পতনের ধারা। ২০২২ সালের জুন মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ার পর এখন হয়তো সরকারের টনক নড়েছে। আইএমএফ নির্দেশ দিয়েছে কয়েক বছর ধরে সরকার এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড থেকে রপ্তানিকারকদের রিফাইন্যান্সিং স্কিমের অধীনে বৈদেশিক মুদ্রায় যে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, সেটাকে রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে। ওই নির্দেশ সরকার মানছে না, কারণ তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত রিজার্ভকে ৩২ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে ফেলতে হবে। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আমদানি এল/সি খোলা জোরেশোরে শুরু হলেও অর্থমন্ত্রী তা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি, কোনো রকম আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপও নেয়নি সরকার; বরং ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কাকে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে রিজার্ভ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়ে বাহবা কুড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রিজার্ভের পতনের এই ধারাকে আমি ২০২২ সালের এপ্রিলে বিপজ্জনক আখ্যায়িত করায় তিনি আমাকে ইঙ্গিত করে ‘অর্বাচীন’ বলে গালমন্দ করেছিলেন। এখন প্রমাণিত হয়েছে আসলে কারা ‘অর্বাচীন’।

 ২০২২ সালের মার্চ থেকে এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম ধাপে ধাপে বাড়তে বাড়তে এখন ১০ গুণ বেড়ে যাওয়ায় সারা বিশ্বে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তেলের দামও ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২২ সালের মে মাসে ব্যারেলপ্রতি ১৪০ ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। গত জুলাই থেকে আসন্ন বিশ্বমন্দার আশঙ্কায় তা আবার কমতে শুরু করেছে, ২৪ আগস্টে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৯ ডলার। আমরা বিপদে পড়েছি আমদানি করা এলএনজির ওপর আমাদের জ্বালানি নীতির অতিনির্ভরশীলতার কারণে।

সরকারের ভুল নীতির কারণেই এহেন অতিনির্ভরতা। দেশের স্থলভাগে এবং ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমায় ১৪ বছর যাবৎ বলতে গেলে কোনো তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালায়নি সরকার। জ্বালানি নীতি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি হিসেবে বর্তমান সরকার বেছে নিয়েছে আমদানি করা এলএনজিনির্ভরতা। কারণ, ২০১০-২০ পর্যায়ে এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৪ ডলার, ২০২২ সালের আগস্টে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ ডলারের বেশি। আর এখন চাইলেই বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকে এই দামেও এলএনজি কিনতে পারছে না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-উদ্ভূত চরম ঘাটতির কারণে।

সে জন্যই প্রশ্ন উঠবে, বর্তমান এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে?বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ রকম বদ্বীপ অঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন সাগর-উপসাগরের তলদেশগুলো সাধারণত সবচেয়ে বেশি হাইড্রোকার্বন (তেল ও গ্যাস) খনির ভান্ডার হওয়াই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের গালফ ডেলটা, ইন্দোনেশিয়ার মহাকাম ডেলটা এবং আফ্রিকার নাইজার ডেলটা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বঙ্গোপসাগরের ভারত উপকূলের অদূরে গোদাবরী বেসিন এবং মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের অদূরে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অঞ্চলের অগভীর সাগরতলে প্রাপ্ত বিপুল গ্যাসভান্ডার এই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করে চলেছে। অথচ বাংলাদেশ ২০ বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুসন্ধানকৃত বা স্বল্প-পরীক্ষিত (least explored) অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই অক্ষম্য ব্যর্থতার দায় কার? বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তো খোদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে, মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের হাতে তো মন্ত্রণালয়ের এত বড় গুরুদায়িত্ব থাকার কথা নয়! গ্যাস অনুসন্ধানে রহস্যজনক বিলম্ব যে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি ঘটিয়ে চলেছে, তার দায় কে নেবে? উল্লেখ্য, প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে কয়েক দশকের বিরোধ সফলভাবে মোকাবিলা করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন লস অব দ্য সিস (ইটলস) এবং দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ, যার পুরো কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের। দুঃখজনক হলো, এই বিজয় অর্জনের আট বছর অতিক্রান্ত হলেও শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অবিলম্বে এই বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে সম্পদ আহরণ জোরদার করাকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার অদূরে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে বেশ কয়েক বছর আগে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রপ্তানি করছে মিয়ানমার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওই অঞ্চলের নিকটবর্তী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটি ব্লক দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানিকে তেল-গ্যাস আহরণের জন্য ইজারা দিয়েছিল। দাইয়ু যথাযথ প্রস্তুতি এবং সরঞ্জাম নিয়ে ওই অঞ্চলে তেল-গ্যাস এক্সপ্লোরেশন চালানোর জন্য কয়েকটি জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদের বাধা দেয় এবং ফিরে আসতে বাধ্য করে। ২০১২ সালের ইটলসের রায়ে ওই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের মালিকানা এখন পেয়ে গেছে বাংলাদেশ, কিন্তু গত দশ বছরেও ওখানে এখনো কোনো নতুন এক্সপ্লোরেশন শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো ইজারাদার কোম্পানি। এই অক্ষম্য বিলম্বের কারণে মিয়ানমার যে এই সমুদ্রাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ গ্যাস তুলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, সেই গ্যাস তো বাংলাদেশও পেতে পারত। কারণ, সন্নিহিত অঞ্চলগুলোর ভূগর্ভে গ্যাসের মজুত তো শুধু মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রসীমায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।

আর একটি বিষয় সত্যিই দুঃখজনক। বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ টন পেট্রলজাত পণ্য আমদানি করলেও ৫৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা হলো মাত্র ১৫ লাখ টন। বাকি ৫৫ লাখ টন আমাদের রিফাইনড জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। আরেকটি বৃহত্তর ক্যাপাসিটির রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি ১০ বছর আগে শুরু করা হলেও রহস্যজনকভাবে সেটা আটকে আছে ভারতীয় কনসালট্যান্ট ফার্মের একগুঁয়েমির কারণে। তারা ফ্রান্সের ‘টেকনিপ’ ফার্মটিকে ডিসকোয়ালিফাই করেছে অজ্ঞাত কারণে। বাংলাদেশ সরকার এত দিনেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারল না? ক্রুড অয়েল আমদানি করে পরিশোধন করলে আমাদের যে খরচ পড়ত, এখন তার চেয়ে ১৫-২০ ডলার ব্যারেলপ্রতি বেশি খরচ পড়ছে রিফাইনড অয়েল আমদানি করায়। এমনকি সম্প্রতি রাশিয়া আমাদের কম দামে ক্রুড অয়েল আমদানির যে সুযোগ দিতে চেয়েছিল, তা আমরা নিতে পারিনি রাশিয়ার ‘হেভি ক্রুড’ রিফাইন করার ক্যাপাসিটি ইস্টার্ন রিফাইনারির না থাকায়! ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের মতো ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প স্থাপন না করে তার চার ভাগের এক ভাগ খরচে ৬০ লাখ ব্যারেল ক্রুড অয়েল পরিশোধনের উপযুক্ত একটি অয়েল রিফাইনারি স্থাপন করলাম না আমরা! এর দায় কার? এখন শোনা যাচ্ছে ভারতের মাধ্যমে রাশিয়ার ডিজেল আমদানির প্রয়াস চালাচ্ছেন আমাদের নীতিনির্ধারকেরা। শেষ পর্যন্ত এই প্রয়াস সফল হলেও লাভের গুড় যাবে ভারতের দখলে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ