এই পৃথিবীতে কিছু ক্ষণজন্মা মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যাঁরা তাঁদের কর্ম ও কীর্তির মাধ্যমে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। এমনই একজন ছিলেন বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামের রণদা প্রসাদ সাহা।
রণদা প্রসাদ সাহা ইংরেজি ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকা জেলার অন্তর্ভুক্ত সাভারের অদূরে শিমুলিয়া ইউনিয়নের কাছৈড় গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দেবেন্দ্র পোদ্দার, নিবাস টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে আর মাতা কুমুদিনী দেবী। তিন ভাই এবং এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ ছিলেন দ্বিতীয়।
দলিল লেখক বাবার আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। বড় ভাই মদন সাহা থাকতেন মামাবাড়িতে। ছোট ভাই ফণীকে মাত্র দুই বছর বয়সে মহেড়ার জমিদারকে পুষ্যি দেওয়া হয়। আর ছোট বোন মরণ দাসীকে মাত্র আট বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়।
রণদা প্রসাদের সাত বছর বয়সে মা কুমুদিনী দেবী সন্তান প্রসবের সময় ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায়, বিনা পথ্যে, অযত্নে-অবহেলায় মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের এই মর্মান্তিক মৃত্যু রণদা প্রসাদের মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, যদি কখনো সম্পদশালী হন মায়ের নামে একটি দাতব্য প্রসূতি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবেন, যাতে কোনো মা সন্তান প্রসবের সময় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ না করেন।
বাবা দেবেন্দ্র পোদ্দার দ্বিতীয় বিয়ে করার পর রণদাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মামাবাড়িতে। মাত্র ১১ বছর বয়সে মামাবাড়ি থেকে পালিয়ে যান। একদিন রণদা প্রসাদ ক্ষুধার যন্ত্রণায় এক বনের ধারে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন। ওই সময়ে মুক্তাগাছার জমিদার রাজা জগৎ কিশোর চৌধুরী সেই বনে শিকার করতে আসেন এবং অচেতন অবস্থায় রণদা প্রসাদকে উদ্ধার করে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন।
মুক্তাগাছার জমিদারবাড়িতে কয়েক বছর অবস্থান করে রণদা জমিদারবাড়ির লোকজনের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার এবং শিল্প-সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হন, পরবর্তী জীবনে যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। ১৯১০ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষণে তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতায় আসেন। এ সময়ে অনেক বাঙালি যুবকের মতো রণদা প্রসাদ স্বদেশি আন্দোলনের সশস্ত্র ধারায় জড়িয়ে পড়েন এবং ধরা পড়ে হাজতবাসও করেন।
যুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালে রণদা প্রসাদ সাহাকে ব্রিটিশ সরকার রেলওয়ের টিকিট কালেক্টরের চাকরি দেয়। ১৯২০ সালেই তিনি বিয়ে করেন বালিয়াটির জমিদারকন্যা কিরণ বালা দেবীকে। ১৯২২ সালে প্রথম কন্যা বিজয়া সাহা জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৩২ সালে রেলওয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। এ বছর জন্মগ্রহণ করেন তাঁর দ্বিতীয় কন্যা জয়া সাহা। নৌযান ব্যবসা বেশ লাভজনক দেখে প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি। একসময় এই কোম্পানিতে ৭৫টি বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজ ছিল। মূলত নৌপরিবহন ব্যবসার মাধ্যমেই রণদা প্রসাদ সাহা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও আর পি সাহা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ সাল মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই আর পি সাহা একজন ধনী, সম্পদশালী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের প্রথম দিকে আর পি সাহা জর্জ অ্যান্ডারসন কোম্পানির সব জুট বেলিং ও প্রেসিং মেশিন, সব পাটের ব্যবসা, কোম্পানির প্রায় ১০০ একর জায়গাসহ যাবতীয় সম্পত্তি কিনে নেন। খানপুরে অবস্থিত অ্যান্ডারসন কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ই আজ কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয়।
১৯৪৩ সালে সারা দেশে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে আর পি সাহা ২৭৫টি লঙ্গরখানা খুলে টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জের অভুক্ত ও বিপন্ন মানুষের প্রায় আট মাস খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। মানবসেবার এই স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতবর্ষের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়াভেল ১৯৪৪ সালের ৮ জুন রণদা প্রসাদ সাহাকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা রবি।
১৯৪৪ সালে বাংলার গভর্নরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের সাহায্যে রেডক্রসকে আড়াই লাখ রুপি দান করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ এবং তাঁর সব সম্পত্তি ট্রাস্টের নামে দান করে দেন। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠা করেন মায়ের নামে ‘কুমুদিনী জেনারেল হাসপাতাল’। সমাজে অধিকারবঞ্চিত, কুসংস্কার আচ্ছন্ন নারীদের স্বনির্ভর করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন প্রমাতামহীর নামে অবৈতনিক ও সম্পূর্ণ আবাসিক স্কুল ‘ভারতেশ্বরী হোমস’। মায়ের নামে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, বাবার নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ, মাগুরায় বন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ডিগ্রি কলেজ, বরিশালে দাঙ্গায় নিহত শহীদ আলতাব হোসেনের নামে শহীদ আলতাব হোসেন মেমোরিয়াল স্কুল, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর কলেজ, চৌমুহনী কলেজ, মির্জাপুরের এস কে পাইলট স্কুল, টাঙ্গাইলের মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ এবং মির্জাপুরের ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যশোরে মাইকেল মধুসূদন কলেজ তাঁরই অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি অর্থায়ন করেছেন।
পাকিস্তানে ইস্কান্দার মির্জা হাসপাতাল এবং আইয়ুব খানের মায়ের নামে হাজেরা জেলায়ও একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরিতাপের বিষয়, পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ১৯৭১ সালের ৭ মে কুমুদিনীর প্রধান কার্যালয় খানপুর থেকে রণদা প্রসাদ সাহা ও তাঁর একমাত্র কর্মক্ষম পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর আর তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
তাঁর স্মৃতিবিজড়িত নারায়ণগঞ্জে রণদা প্রসাদ সাহার সুযোগ্য পৌত্র রাজীব প্রসাদ সাহা ২০১৩ সালে ‘রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। রণদা প্রসাদ সাহাকে ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। ১৯৯১ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরিজে রণদা প্রসাদ সাহা স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে। রণদা প্রসাদ সাহার মৃত্যু নেই।
তিনি কালজয়ী এক মহামানব। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
লেখক: উপাচার্য, রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়