নিজে পড়াশোনার মানুষ। কিন্তু সন্তানদের পড়ানোর ব্যাপারে অনীহা ছিল শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানের। ১৯৮২ সালে মেয়ে রুচি মানবিক বিভাগ থেকে ২০তম স্থান অধিকার করল। তাতে খুশি হয়েছিলেন বাবা। রুচি বিজ্ঞানের ছাত্রী না হলেও চতুর্থ বিষয় হিসেবে নিয়েছিল গণিত, যাকে ইলেক্টিভ ম্যাথ বলা হয়। অর্থনীতিতে অনার্স পড়বে বলে এই সিদ্ধান্ত। সেটা রুচির নম্বরকে অনেক বেশি পোক্ত করেছিল। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও জুটেছিল রুচির। সিদ্দিকা জামান বললেন, ‘বাবা-মার জীবনে এর থেকে বেশি আনন্দ আর কিছুই হতে পারে না।’ এখলাসউদ্দিন আহমদ এসে আনিসুজ্জামানকে বললেন, ‘সারা বছর ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খবর নেই। কেবল পরীক্ষার ফল বের হলেই আপনি খোঁজ নেন!’
কথাটা সত্যি। কিন্তু তার কিছু কারণও ছিল। তারই একটা এ রকম: একবার আনিসুজ্জামান তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে পড়াতে বসলেন। স্কুলে বাড়ির কাজ কী দেওয়া হয়েছে শুনতে চাইলে ছেলে আনন্দ বলল, ‘চার লাইন কবিতা মুখস্থ করতে দিয়েছে।’
আনিসুজ্জামান প্রশ্ন করলেন, ‘মুখস্থ করেছ?’ আনন্দ বলল, ‘দুই লাইন করেছি।’
আনিসুজ্জামান বললেন, ‘চার লাইন মুখস্থ করতে দিয়েছে, দুই লাইন করেছ কেন?’
আনন্দ জবাব দিল, ‘স্যার এক লাইন শুনেই বলেন, বসো।’
আনিসুজ্জামান বুঝলেন, ক্লাসে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী, তাতে ওই অতটুকু সময়ের জন্য শিক্ষকের পক্ষে পড়া ধরা কঠিন। ছাত্রছাত্রীরা সেটা বুঝে গিয়ে এই চালাকিটা করে। এরপর সন্তানদের পড়াশোনার তদারকি করা আনিসুজ্জামানের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।
ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার জন্য খেটেখুটে প্রস্তুতি নেয়নি আনন্দ। ওর রেজাল্ট কী হতে পারে, সে কথা ভেবে পরিবারের মানুষেরা শঙ্কিত ছিল। যেদিন রেজাল্ট বের হলো, সেদিন আনন্দ এসে বলল, ‘ক্লাসের একটি মেয়ে বলেছে, আনন্দ জামান বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।’
কেউই সে কথা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু স্কুলের শিক্ষক আলেফ হোসেন খবরটি নিশ্চিত করার পর বাড়িতে আনন্দ হিল্লোল বয়ে গেল। তদারকি না করলেও আনিসুজ্জামানের একটা প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি কি ফলাফলে দেখা গেল না?
সূত্র: সিদ্দিকা জামান, আমার বিপুলা পৃথিবী, পৃষ্ঠা ৫১-৫২