হোম > ছাপা সংস্করণ

‘মেয়েকে বলে রেখেছি, আমার মৃত্যুর পর কোনো রাষ্ট্রীয় পদক নেবে না’

মীর রাকিব হাসান

বাংলাদেশে হাওয়াইয়ান গিটার জনপ্রিয় করার নেপথ্য সৈনিক শিল্পী এনামুল কবির। বয়স এখন ৮০। কৈশোর-যৌবনে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহ, সান্নিধ্য। স্বাধীনতার গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, বঙ্গবন্ধুর গান, দেশাত্মবোধক গান, লোকজ গানে তাঁর অবদান উল্লেখ করার মতো। জনপ্রিয়তা, সম্মান, পুরস্কার—সবই মিলেছে, মেলেনি আজ অবধি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন মীর রাকিব হাসান

ঘরজুড়ে স্মৃতিকাহন
বাসায় ঢুকলেই চারপাশে সংগীতের আবহ। কোথাও গিটার, কোথাও নিজের সম্পাদিত স্বরলিপির বই কিংবা গান আর নিজ বাদনের গিটারের ক্যাসেট, সিডি। আলাপে আলাপে এনামুল কবির আমন্ত্রণ জানালেন বাসা ঘুরে দেখার। বললেন, ‘আমার প্রায় ৬৫ বছরের সংগীতজীবনের সংগ্রহশালা।’ তাঁর নিজস্ব রেকর্ডিং স্টুডিও, আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, বই, সিডি, ক্যাসেট। দেয়ালে ঝুলছে স্বনামধন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডার কিছু স্থিরচিত্র, যেখানে রয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদসহ অনেকর সঙ্গে তোলা ছবি। এনামুল কবির জানালেন, ছেলে এনায়েত কবির চঞ্চল ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের একসময়ের ভিপি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন, সেই সময় যাঁরা তাঁকে নিরাপত্তা দিতে বুক পেতে সামনে থাকতেন, তাঁদের একজন ছিলেন চঞ্চল। পরে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন চঞ্চল। শেখ হাসিনার যেমন ছিলেন আস্থাভাজন, ছিলেন স্নেহভাজনও। তাই ঘরোয়া অনুষ্ঠানাদিতে শেখ হাসিনা বাসায় আসতেন।

নেই রাষ্ট্রীয় সম্মাননা
ঘরজুড়ে রয়েছে দেশের বিভিন্ন সংগঠন থেকে প্রাপ্ত অসংখ্য সম্মাননা—পদক, পুরস্কার। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও এসেছে সম্মাননা। কিন্তু নেই কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা-পদক। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম, রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা পাননি? এনামুল কবির হাসিমুখে বললেন, ‘সেজন্য আক্ষেপ নেই। আমি হয়তো এখনো সেই সম্মানের যোগ্য হইনি। তবে মেয়েকে বলে রেখেছি, আমার মৃত্যুর পর যেন কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা গ্রহণ করা না হয়। আমি আমার শ্রোতা ও দেশের মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে এখনো দেশের সংগীতের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, এর ওপরে আর কী সম্মান হতে পারে! বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ দিয়েছেন, আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সুরে গানে স্বরলিপিতে কিছু করতে পেরেছি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি—এটাই তো বড় প্রাপ্তি। আমার চাওয়া হলো, রাষ্ট্রীয় পদকের যেন অবমাননা না হয়।’

আক্ষেপ তো আছেই
বেশ কিছু বিষয়ে আক্ষেপ রয়েছ এনামুল কবিরের। বললেন, ‘সংসদ টেলিভিশনে সারাক্ষণ যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজে, তা আমার বাজানো হাওয়াইয়ান গিটারের সুর। অথচ এর জন্য কর্তৃপক্ষ আমার অনুমতি দূরের কথা, রয়্যালটি পর্যন্ত দেয় না, কোনো দিন ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়নি। আর বড় আক্ষেপের বিষয়, আমার নামটা পর্যন্ত তারা কখনো উল্লেখ করে না।’ আরেকটি বিষয় নিয়ে আক্ষেপ আছে। বঙ্গবন্ধুর ১১০টি ভাষণের ২৭টি সিডি তৎকালীন তথ্যপ্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়। এনামুল করিম বললেন, ‘একদিন অধ্যাপক সায়ীদ ফোন করে বললেন, কবির ভাই, বঙ্গবন্ধুকে এই দেশে মুছে ফেলার পাঁয়তারা চলছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর যেখানে যে ভাষণ আছে, তা সংরক্ষণ করে সিডি আকারে প্রকাশ করব এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি ভাষণের আগে আপনার বাজানো হাওয়াইয়ান গিটারের সুর সংযোজন করব। মুক্তিযুদ্ধের গানের ওপর আপনার বাজানো সিডিগুলো যদি দেন, উপকৃত হব। আমি আনন্দের সাথে আমার সব সিডি দিলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি ভাষণের আগে আমার বাজানো সুর সংযোজিত হলো। যথাসময়ে ২৭টি সিডি প্রকাশিত হলো। বিচারপতি হবিবুর রহমান ঘটা করে উদ্বোধন করলেন। আমি গর্বের সঙ্গে সেই অনুষ্ঠানে পরিবারসহ গেলাম। সৌজন্য কপি দেওয়া তো দূরের কথা, কোথাও আমার নামটি পর্যন্ত উচ্চারিত হলো না। পরবর্তী সময়ে সিডিগুলো কিনলাম, কিন্তু সেখানেও আমার নামটি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অধ্যাপক সায়ীদকে অনুযোগ করলাম, তিনি দুঃখ প্রকাশ করে পরবর্তী সংস্করণে নাম সংযোজনের প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু আজও নাম সংযোজিত হয়নি। আক্ষেপ যেমন থেকে গেছে, আনন্দও তো কম না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগে আমার বাজানো হাওয়াইয়ান গিটারের সুর সংযোজিত হয়েছে, আমি গর্বিত।’

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা
১৯৫৭ সালে এনামুল কবিরকে তাঁর আশরাফ চাচা ঢাকার গেন্ডারিয়ার এক বাসায় নিয়ে গেলেন। এনামুল কবির বলেন, ‘আমি তখন হাফপ্যান্ট পরি। বিশাল এক রুম, সাদা চাদর বিছানো। কতকগুলো কোলবালিশ রাখা। একসময় দেখলাম, এক ভদ্রলোক পাইপ টানতে টানতে সাথে বেশ কজনকে নিয়ে ঘরে ঢুকছেন। আমি জানতাম না উনি কে। আমি সেখানে কাউকেই চিনি না। শুধু চিনলাম মানিক মিয়াকে, দৈনিক ইত্তেফাকের সুবাদে। ইত্তেফাকে তাঁর ছবি ছাপা হতো বলে। এর মধ্যে লোকে ঘর ভরে গেছে। কথাবার্তা চলছে, আর এক কোনায় আমি ঝিমুচ্ছি। চাচা বললেন, চল তোকে বাসায় দিয়ে আসি। চলে যাব, এমন সময় বঙ্গবন্ধু বললেন, এই আশরাফ, ওই ছ্যামরাডা কেডা? চাচা বললেন, ভাইয়ের ছেলে। বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, তোর চুলগুলান তো ভারী সুন্দর! বাইরে এসে চাচা বললেন, ‘তোর মাথায় যিনি হাত বোলালেন, কথা বললেন, উনি শেখ সাব। আমাদের অনেক বড় নেতা।’

বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম শামসুজ্জোহা। তাঁর স্ত্রী নাগিনা জ্বোহা এনামুল কবিরের কাছে হাওয়াইয়ান গিটার শিখতেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পেলে একটি নৌবিহারের আয়োজন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশ কয়েকজন ডেলিগেট এলেন। এ কে এম শামসুজ্জোহা দাওয়াত করলেন এনামুল কবিরকে। বললেন, ‘কবির ভাই, বঙ্গবন্ধু নৌবিহারে যাবেন। সেখানে পাকিস্তানি অতিথিদের বাংলা গান শোনাতে হবে। সাথে আরো কিছু শিল্পী নিয়ে আপনি আমাদের সাথে যাবেন।’ উস্তাদ নিতাই রায়, সরদার আলাউদ্দীনসহ বেশ কয়েকজন শিল্পী ও যন্ত্রী নিয়ে মেরি এন্ডারসন জাহাজে উঠলেন এনামুল কবির। পাগলা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ছিল নৌবিহার। যাওয়া-আসার পথে প্রচুর গান হলো। গিটারে গানের সুর তোলা হলো। বাজানো শেষ হলে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই তো আমার পছন্দের গান বাজায়ছস। তোর বাড়ি কোহানে? এনামুল বললেন, ‘যশোরের কালিয়া থানায়।’ ‘কালিয়ার কোন গ্রাম? বাপের নাম কী?’ এনামুল উত্তর দিলেন ‘শেখ সরোয়ার।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ও! সরোয়ার মিঞা ভাই! গোপালগঞ্জে স্কুলে আমার এক বছরের সিনিয়র ছিল। তুই তার ছাওয়াল?’ নিজের পাশে বসিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই তো ভালো গিটার বাজাস। চালায়া যা। একদিন বড় শিল্পী হবি, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবি।’

মুক্তিযুদ্ধে গান সংগ্রহ
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়ে গেল, এনামুল কবির তখন ঢাকায়। জানালেন সে সময়ের স্মৃতি, ‘গোপনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম আর মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপনামূলক গানগুলো রেকর্ড করে রাখতাম। পরে দরজা-জানালা বন্ধ করে সেসব গানের স্বরলিপি করে সংগ্রহে রাখতাম। বিশ্বাস করতাম, দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। তখন এসব স্বরলিপি, গান কাজে লাগবে। পরবর্তী সময়ে ঠিকই কাজে লাগিয়েছি। সেসব গানের স্বরলিপি বই আকারে প্রকাশ করেছি, গিটার বাদন ক্যাসেট-সিডি আকরে প্রকাশ করেছি। প্রতিটি গানের মূল শিল্পী, গীতিকার, সুরকারসহ বিভিন্ন তথ্য সংযোজনের চেষ্টা করেছি, ফলে এসব গান টিকে থাকবে যুগের পর যুগ। শুধু তাই নয়, স্বরলিপির পাশাপাশি স্টাফ নোটেশন করে গানগুলো ভিনদেশি ভাষাভাষীদের জন্য তুলে ধরেছি। দেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুরে গানে জানার একটা সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি।’

বাঁশি ছেড়ে গিটার
কৈশোরে শেখ কাওসার নামের এক চাচার বাজানো সুর শুনে প্রথম বাঁশির প্রেমে পড়েন এনামুল কবির।  চাচার পেছনে ঘুরে ঘুরে একসময় শিখে ফেলন বাঁশি বাজানো। এরপর পড়াশোনার জন্য চলে আসেন ঢাকায়। হঠাৎ বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে ডাক্তারের পরামর্শে ছাড়তে হয় শখের বাঁশি। বিশ্রামের জন্য বছরখানেক গ্রামে গিয়ে থাকতে বললেন চিকিৎসক। ঢাকা ছাড়ার আগে মনে হলো সংগীত ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। হাতে তুলে নিলেন গিটার। সেটা ১৯৫৯ সালের দিকের কথা। ঘরে বসে কলকাতা, শিলং রেডিওতে প্রচারিত গিটার বাজনা শুনতেন। গান শুনে শুনেই হারিকেনের আলোয় সন্ধ্যার পর গিটার নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চর্চা করতেন।

১৯৬৪ সালে বেতারে হাওয়াইয়ান গিটারশিল্পী হিসেবে তালিকাবুক্ত হন। টেলিভিশনে প্রথম সুযোগ পান ১৯৬৯ সালে। অনেক চলচ্চিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজিয়েছেন। একসময় সুর করা শুরু করেন এবং খ্যাতি অর্জন করেন।গিটারের শিক্ষক হয়ে ওঠা
গ্রাজুয়েট স্কুল শেষ করে তৎকালীন জিন্নাহ কলেজে ভর্তি হলেন এনামুল কবির। এদিকে গিটারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে (বাফা) মাত্র ছয় মাসের শিক্ষা। অনিবার্য কারণে চার বছরের সার্টিফিকেট কোর্স শেষ করা হয়নি। এরপর নিজের অদম্য চেষ্টায় হয়ে ওঠেন দেশে-বিদেশে হাওয়াইয়ান গিটারের এক দিকপাল। যেকোনো অনুষ্ঠানেই ডাক পড়ত। অনেকই আবদার করতেন গিটার শেখানোর জন্য। সেই আবদার মেটাতে মেটাতেই একসময় হয়ে ওঠেন ‘গিটারের স্যার’। এনামুল কবির বলেন, ‘আমি তখন নারিন্দায় থাকি। পাশেই থাকতেন বর্তমান সময়ের মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী গোলাম দস্তগীর। আমার কাছে গিটার শেখা শুরু করলেন। অসংখ্য ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতী, ছাত্রছাত্রী, গৃহবধূ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারকে গিটার শিখিয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, সাবেক রাষ্ট্রপতি, তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা ও খ্যাতিমান ডাক্তার এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর স্ত্রীকেও শিখিয়েছি।’ ১৯৬৪ সালেই এনামুল কবির বেতারে হাওয়াইয়ান গিটারশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। টেলিভিশনে প্রথম সুযোগ পান ১৯৬৯ সালে। অনেক চলচ্চিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজিয়েছেন, এর মধ্যে ‘অনন্ত প্রেম’ উল্লেখযোগ্য। এরপর সুরকার হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর সুরারোপিত গানে হৈমন্তী শুক্লা, সুবীর নন্দীসহ দেশের বিশিষ্ট শিল্পীরা কণ্ঠ দেন। গীতিকার কে জি মুস্তাফার অসংখ্য গানে তিনি সুর দিয়েছেন। আর স্বরলিপিতে সিদ্ধহস্ত এপার-ওপারে তাঁর মতো গুণী খুঁজতে হবে।

ইলেকট্রনিকস দোকানে গিটারের চর্চা
১৯৬৫ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। স্ত্রী মমতাজ জাহান একসময় বললেন, ‘সারা জীবন গিটার বাজিয়ে সংসার চলবে না। এর পাশাপাশি কিছু একটা করা উচিত।’ তখন স্টেডিয়ামে একটা ইলেকট্রনিকসের দোকান করলেন এনামুল কবির ‘মিতা ইলেকট্রনিক্স’ নামে। দোকান করার পর সংগীতের চর্চা আর হাওয়াইয়ান গিটারের  প্রসার আরো বেড়ে গেল। দোকানে তাঁর বাজানো হাওয়াইয়ান গিটারের ক্যাসেট দেদার বিক্রি হতে শুরু করল, আয় বাড়ল, উৎসাহ বাড়ল। শুরু হলো একের পর এক হাওয়াইয়ান গিটার বাদনের ক্যাসেট প্রকাশনা। ১৯৬৯ সালে প্রথম ছোট পরিসরে একটি স্বরলিপির বই প্রকাশ করলেন। এরপর ১৯৮৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বেশ কিছু জনপ্রিয় গান নিয়ে প্রকাশিত হলো ‘জন্মভূমির গান’ শিরোনামে দ্বিতীয় স্বরলিপির বই। এরপর তো তিনি থেমে থাকেননি। এক এক করে বিভিন্ন ধরনের গান নিয়ে বিভিন্ন শিরোনামে আজ অবধি প্রকাশ করেছেন প্রায় ২৬টি স্বরলিপির বই, যেখানে স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গান, বঙ্গবন্ধুর গান, দেশাত্মবোধক গান, বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গান, লালন, হাসন, রবীন্দ্র, নজরুলের গান, হিন্দি, উর্দু—এমন কোনো জনপ্রিয় গান নেই, যার স্বরলিপি তিনি করেননি। শুধু তাই নয়, সেসব গান আবার হাওয়াইয়ান গিটারে বাজিয়ে ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডি করেছেন; যার সংখ্যা হবে প্রায় ৬০। এসব স্বরলিপি বই ও সিডিতে কম-বেশি প্রায় দেড় হাজার গান স্থান পেয়েছে।

পঁচাত্তরের পর নীরবে চলেছে প্রতিবাদ
স্টেডিয়াম মার্কেটে নিজের ইলেকট্রনিকসের দোকানে বসে লাউড স্পিকারে উচ্চ ভলিয়মে বাজাতেন হাওয়াইয়ান গিটারে নিজের বাজানো যত সব মুক্তিযুদ্ধের গানের সুর। এর জন্য কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাঁকে, হুমকিও এসেছে। এনামুল কবির বলেন, ‘জিয়াউর রহমান বা এরশাদ সরকারের আমল বলো, সব সময়ই আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন গানগুলোই বাজাতাম। যেমন—‘জয় বাংলা’, ‘শোনো একটি মুজিবুরের থেকে’, ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’ ইত্যাদি। প্রতিবেশী দোকানের মালিকরা বলতেন, ‘আপনি যে বঙ্গবন্ধুর গান, জয় বাংলার গান বাজান, তাতে আপনার তো বিপদ হবে, সঙ্গে আমাদেরও ক্ষতি হয়ে যাবে।’ স্টেডিয়াম মার্কেটের তখনকার সভাপতি মহিউদ্দিন ভাই, যিনি একসময় বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড ছিলেন, তাঁকে বিষয়টি জানালাম। তিনি বললেন, ‘আপনি বাজিয়ে যান, কে কী করে আমি দেখব।’ তখন সবাই জানতেন, জিয়া কিংবা এরশাদের আমলে বঙ্গবন্ধু বা স্বাধীনতার সপক্ষীয় কোনো কাজ করা মানে বিপদ। যা হোক, সাহস নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষীয় কাজ তখনো করেছি, এখনো করে যাচ্ছি, কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের আশায় নয়। কৈশোর, যৌবনে বঙ্গবন্ধুর যে আশীর্বাদ পেয়েছি, সেই থেকে তাঁর প্রতি ভালোবাসা আর দেশের সংগীতের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে, টিকিয়ে রাখতেই আমার এই নিরলস শ্রম। আর এখানেই আমার তৃপ্তি, আনন্দ। এ কারণেই দেশের গানগুলো শুদ্ধ সুরে স্বরলিপি করে রেখে যেতে পারলাম। এমনও গানের স্বরলিপি বা বাজনা আছে, যা বাংলাদেশ বেতার বা টেলিভিশন, এমনকি জাতীয় আর্কাইভেও নেই। আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমার একেকটি স্বরলিপির বই একেকটি আর্কাইভ। আরো উল্লেখ করতে চাই, যখনই যে গানটি স্টেডিয়ামে বাজাতাম, সেই ক্যাসেটটি কেনার জন্য শ্রোতারা দোকানের সামনে ভিড় করত। দেদার বিক্রি হতো 'জয় বাংলা' গানের সুরের ক্যাসেট। আজ সব ইতিহাস।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা
এনামুল কবিরের জন্ম ১৯৪২ সালের ৫ জুলাই নড়াইল জেলার নড়াগাতী থানার ডুমুরিয়া গ্রামে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বাড়িতে কলের গান বাজতে শুনেছেন। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়ে যায়। বাবার সরকারি চাকরির সুবাধে চলে যেতে হয় কলকাতায়। শৈশব কেটেছে কলকাতায়। ১৯৪২ থেকে ৫০ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন। দেশভাগের সময় খালি হাতেই কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এলেন।

পরিবার
এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে এনায়েত কবির চঞ্চল ২০১৫ সালে মারা যান। স্ত্রী মারা গেছেন ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, এপ্রিলে ছেলে। মেয়ে নাহিদ কবির কাকলী কানাডায় আছেন অনেক বছর ধরে। ওখানে ব্যাংকে চাকরি করেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীও কাকলী। অনেকগুলো গানের অ্যালবামও বের হয়েছে। ছেলের ঘরে তিন নাতি। মেয়ে কাকলীর এক কন্যাসন্তান আছে।

সময় কীভাবে কাটে
গত দুই বছর তো করোনায় ঘরবন্দি সময় গেল। সময় তো কাটতেই চায় না। এনামুল কবির বলেন, ‘মঙ্গলবার আমার বাসায় একটা গানের আসর বসে। আমার গানের বন্ধুরা আসে, আড্ডা হয়, গান গাওয়া হয়। এখনো স্বরলিপি করি, গিটার বাজাই। করোনাকালীন অনলাইনে প্রচুর প্রোগ্রাম করতাম আমরা। শুধু গিটারে গান বাজানোই আমার শেষ নয়, আমি নিজে যা শিখেছি, তা ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছেতেই ছাত্রছাত্রীদের শেখানো শুরু করি। ১ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রীকে আমি হাওয়াইন গিটার শিখিয়েছি।’

সংগীতের আর্কাইভ এনামুল কবির
এনামুল কবির সম্পর্কে তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার সঙ্গীত আমার জীবন‘ পড়ে কিংবা বাসার প্রতিটি রুম স্বচক্ষে দেখে, তাঁর সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতায় এতটুকুই প্রমাণ মেলে যে, ‘এনামুল কবির সত্যিই এ দেশের সংগীত ভুবনের আর্কাইভ’, ‘দেশের সংগীতের আলোকবর্তিকা’। যিনি তাঁর সংগীতজীবনের ৬৫টি বছর রাত-দিন এত কাজ করেছেন, যা আর দশজন সংগীতজ্ঞের ক্ষেত্রে পাওয়া দুষ্কর। একাধারে তিনি হাওয়াইয়ান গিটারশিল্পী, সুরকার, স্বরলিপিকার, গায়ক, দেশের অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সম্মুখ সারির যোদ্ধা।  তাহলে দেশকে ভালোবেসে, দেশের সংগীতকে ভালোবেসে, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবেসে আর কত কাজ করলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলবে তা আমাদের জানা নেই।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ