রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন শেষ হওয়ার নয়। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ, ওদেসা, খেরসন, বাখমুতের পশ্চিমাঞ্চলসহ একের পর এক চলছে অবিরাম ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ। ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ; বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, কারখানার উৎপাদনসহ সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়ছে। ইউক্রেনের জনজীবন বিপর্যস্তপ্রায়।
রাশিয়া যেদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছে, ১২ এপ্রিল; সেই উদ্যাপনের দিন পুতিন স্পষ্টভাবে বলেছেন, যুদ্ধ সবেমাত্র শুরু। এ কথা বলার একটা তাৎপর্য আছে।
রাশিয়া ইউক্রেনের সম্পদ বা স্থাপনা ধ্বংস করতে চাইছে না। রাশিয়া এখনো মনে করে, ইউক্রেনের ৫০ ভাগের বেশি জনসংখ্যা দেশটির নীতিকে সমর্থন করে। তাই রাশিয়া নির্বিচারে ইউক্রেনের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় আক্রমণ করছে না।
রাশিয়া চাইলে তার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে সাত দিনের মধ্যে কিয়েভ শহর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে। কিন্তু রাশিয়া সব সময়ই সমূলে নির্মূলের বিপক্ষে। রাশিয়া এখনো চাইছে যেন ইউক্রেনের রাজনীতিকেরা ভুল বুঝতে পারেন, রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় আসেন। জেলেনস্কি পশ্চিমাদের হাতের পুতুল, এ কথা ইউক্রেনের জনগণ জানে। তারা শুধু প্রতিবাদ করতে পারছে না মৃত্যুঝুঁকির ভয়ে। তাদের হুমকির মুখে রাখছে জেলেনস্কি সরকার।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে চাই। কিছুদিন আগে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দার্শনিক ও সমাজবিদ নোয়াম চমস্কি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যে পরিমাণ ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল, বাগদাদ শহরটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল, লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছিল। সেই তুলনায় রাশিয়া ইউক্রেনকে তাদের মুঠোয় পেয়েও ইরাকের তুলনায় এক শ ভাগের এক ভাগও আক্রমণ করছে না। এখন পর্যন্ত সেখানে আট হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর সময় বহু বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কিয়েভ সফর করেছেন। রাশিয়া ইচ্ছা করলে এসব সফর নিমেষের মধ্যেই ভন্ডুল করে দিতে পারত। এখানেই তফাত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে রাশিয়ার। যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ব্যয়ের সামান্য কিছু ইউক্রেনকে দিয়ে রাশিয়াকে স্তব্ধ করতে চাইছে। প্রথমে গর্বাচেভ ও ইয়েলৎসিনকে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দিয়েছিল। এখন ইউক্রেনকে দিয়ে, অর্থাৎ এই যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত করে রাশিয়াকে ভাঙতে অথবা ক্ষমতা খর্ব করতে চাইছে।
পশ্চিমারা যে খেলায় মেতেছে, দূরদর্শী পুতিন সেই খেলা ধরে ফেলেছেন। একটা কথা মনে রাখা দরকার, পুতিন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, এর আগে ১০ বছর কেজিবির প্রধান ছিলেন। পশ্চিমাদের কূটচাল, বিশ্বরাজনীতি, সমসাময়িক বিশ্ব পরিস্থিতি—এসব পুতিন ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছেন। ২০ বছরে পুতিন তাঁর দেশের অর্থনৈতিক, সামরিক শক্তিসহ সব শক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে নিয়েছেন।
২০২১ ও ২২ সালে শুধু গম রপ্তানি থেকে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে রাশিয়া। আমরা আগে তেলের খনি বলতে জানতাম ওপেকভুক্ত দেশ ও মধ্যপ্রাচ্য। ইউক্রেনে অপারেশন শুরুর পর থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি রাশিয়া তেল সম্পদে কত সম্পদশালী! বলতে গেলে গোটা ইউরোপ রাশিয়ার তেলের জন্য হাহাকার করছে। গ্যাসের কথা বাদই দিলাম। রাশিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপ খনিজ সম্পদ ও কাঁচামাল আমদানি করে। যুদ্ধ আরও দুই বছর চলতে থাকলে ইউরোপসহ সারা বিশ্ব বুঝতে পারবে, রাশিয়ার খনিজ বা প্রাকৃতিক সম্পদের কত মূল্য।
যুক্তরাষ্ট্র তার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্যাট্রিয়ট-টু কয়েক মাস আগে ইউক্রেনকে দিয়েছিল, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ডলার। রাশিয়ার এক মিসাইলের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে! এখন থেকে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে কোনো ভারী অস্ত্র সরবরাহ করতে সাতবার চিন্তাভাবনা করবে। গ্রেট ব্রিটেনের ইউরেনিয়ামবাহিত একধরনের মিসাইল ইউক্রেনকে দেওয়ার কথা। রাশিয়া এটা আগে থেকেই জানে। এই মানবঘাতী অস্ত্র রাশিয়ার জনসাধারণের ওপরে প্রয়োগ করবে আর রাশিয়া বসে বসে তা সহ্য করবে, এটা মনে হয় হবে না। এই অস্ত্র ইউক্রেনের মাটিতে আসার আগেই রাশিয়া ধ্বংস করে দেবে—এই সক্ষমতা দেশটির আছে।
দুই-তিন দিন আগের খবর—যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেবে। যুদ্ধবিমান চালানোর জন্য ইউক্রেনের পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই এফ-১৬ কী করে মোকাবিলা করতে হয়, রাশিয়া ৩০ বছর আগে সেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
রাশিয়াকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে, সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরাজিত করা যাবে না। এসব নিষেধাজ্ঞা অস্ত্রের ভয়ে রাশিয়া ভীত নয়, তা প্রমাণিত। আমরা জানি, রুশরা বিজ্ঞানমনস্ক, বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন জাতি। তাদের মেধা আছে, সম্পদ আছে। পৃথিবীর বিশাল একটি অংশ রাশিয়া, জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ১৪ কোটি। এরপর আছে কয়েক যুগের অস্ত্র বানানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণের বাস্তব অভিজ্ঞতা। এসব কথা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা জানে। তবু তাদের এক কথায় বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পরীক্ষার একটা ক্ষেত্র দরকার ছিল, সেটার জন্য বেছে নিয়েছে ইউক্রেনকে। সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপকে সম্পূর্ণ তার অনুগত করেছে। বর্তমানে একটি জিনিস প্রমাণিত হয়ে গেছে, যুক্তরাজ্য কোনো শক্তি নয়, কোনো স্বাধীন সত্তার দেশ নয়, যুক্তরাজ্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নক।
পুতিন এখন চাইছেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করে আমেরিকার একচেটিয়া বিশ্বব্যাপী ডলারব্যবস্থার বিপরীতে অন্য কোনো মুদ্রা দাঁড় করাতে, একমুখী বিশ্বব্যবস্থা থেকে বিশ্বকে বহুমাত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় নিয়ে যেতে। এ কথা যুক্তরাষ্ট্র জানে, তবু শেষরক্ষা করতে গিয়ে ইউক্রেনকে এখনো সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
কিছুদিন আগে চীন মধ্যস্থতা করার কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল এই যুদ্ধ বন্ধের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের তা পছন্দ হয়নি। সবাই বলতে চাইছে, রাশিয়া ও চীন মিত্রদেশ, অতএব চীনের শান্তিচুক্তি তারা মানতে চায় না। এখন আফ্রিকার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা একটি শান্তি-প্রক্রিয়া উপস্থাপন করেছে। মনে হয় এটাই উপযুক্ত সময়—আমেরিকা তার ভুল বুঝবে, পশ্চিম ইউরোপ তাদের অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করবে।
যেহেতু রাশিয়া মনে করছে ইউক্রেনের ৫০ ভাগের বেশি মানুষ রাশিয়ার সমর্থক এবং একই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ, তাই তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। কোনো একটি মধ্যস্থতাকারী দেশের প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই যুদ্ধ বন্ধ করা যায়। আশা করব, অচিরেই দক্ষিণ আফ্রিকা মধ্যস্থতা করে এই যুদ্ধের অবসান করবে।